সুন্দরবন দিবস

ফারুক আহমেদঃ ‘খুলনা ঘোষণা’ নামে সুন্দরবনের জন্য ১৮ দফার সংরক্ষণ কৌশল দাবি করেছিল সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ। ২০০১ সালে জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে উচ্চারিত হয়েছিল এ দাবিসমূহ ‘খুলনা ঘোষণার’ আদলে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ এ সম্মেলনের ফিতা কেটেছিলেন। সুন্দরবন রক্ষায় ব্যাপক জনমত সৃষ্টির ফলশ্রুতিতে সকলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ‘খুলনা ঘোষণা’ ব্যাপক সমর্থন পায় পরিবেশবাদীদের কাছ থেকে। কিন্তু সুদীর্ঘ ২১টি বছরেও এ ঘোষণার মর্যাদা আসেনি। বন বিভাগ গুরুত্ব দেয়নি সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের আবেগকে। নীতি নির্ধারণী মহল আমলে আনেনি ১৮ দফার কোন একটিও। এমনি অবজ্ঞাপ্রসূত দৃষ্টিভঙ্গিতে এ অঞ্চলের মানুষের সুন্দরবনের প্রতি আবেগ এবং বাস্তবতা কোনটিই ধোপে টেকেনি। ফলশ্রুতিতে সুন্দরবনের সংকট এখন আরো সংকটময় হয়েছে। সুন্দরবনের নদী আরও দূষিত হচ্ছে। নদী ভরাট হচ্ছে, নদী ভাঙ্গছে। বন্যের প্রাণায়ু বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। উদ্ভিদবৈচিত্র্য ক্ষয়িঞ্চু হচ্ছে। উদ্ভিদ-প্রাণীর ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সার্বিক অর্থে জগৎখ্যাত জীববৈচিত্র্য ক্রমেই ধ্বংস হচ্ছে।
খুলনা ঘোষণায় ১৮টি দফা রয়েছে। কি আছে এই ১৮ দফায়? এই দফাগুলো কি শুধুই পোশাকী দফা-নাকি এর সাথে প্রকৃত অর্থেই সুন্দরবনের ভালমন্দ জড়িত? প্রশ্নগুলোর উত্তর বিশ্লেষণ করলে যেটি দাঁড়ায় তাহলো- সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য যে কোন মূলেই রক্ষা করতে হবে। এই রক্ষা উদ্যোগের কোন বিকল্প নেই-কোন কিছুর বিনিময়েই।
১৮ দফার মধ্যে দেখা যায়, প্রথমেই রয়েছে-সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে এ অঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে। এরপরে রয়েছে, জাতির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার রক্ষা, হরিণসহ সকল প্রকার প্রাণী হত্যা বন্ধসহ যাবতীয় বেআইনী কার্যকলাপ বন্ধ, সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে যাতে তার কোন ক্ষতিকর প্রভাব সুন্দরবনে না পড়ে সে ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের এ অপূর্ব সমাহারকে সংরক্ষণ, নবায়ন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সুন্দরবনের পরিবেশ-প্রতিবেশ বিপন্নকারী যে কোন কার্যকলাপ বন্ধ, আইনানুগভাবে সম্পদ আহরণকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং যথার্থভাবে সুন্দরবন সংরক্ষণের পক্ষের শক্তি হিসাবে তাদেরকে বিকাশে সংগঠিত করা।
খুলনা ঘোষণায় আরো রয়েছে, বিশ্ব সংরক্ষণ এলাকা হিসাবে ঘোষিত সুন্দরবনের অংশে সকল প্রকার সম্পদ আহরণ, সংরক্ষণ ও নবায়নের সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, বন ও বন্যপ্রাণী আইনকে আরও যুগোপযোগী ও প্রয়োগবাদী করা অথবা প্রয়োজনে সুন্দরবনের জন্য পৃথক আইন করা, সুন্দরবনের ভিতর বা পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীসমূহের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা, বিশেষ করে গড়াই নদী শাসনের ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো, সুন্দরবন এলাকায় চিংড়ির পোনা ধরার জন্য অন্যান্য কারণে মাছসহ বিভিন্ন জলজ সম্পদের যে অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হচ্ছেতা’ রোধ করা, সুন্দরবনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ট্যুরিজম স্থান হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিবেশসম্মত কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করা।
ঘোষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ দফা ছিল, খুলনা বিশ্ব বিদ্যালয়ের অবস্থান, দক্ষতা ও আগ্রহ বিবেচনা করে সুন্দরবন বিষয়ক গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমে প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ ভূমিকা রাখার সুযোগ প্রদান করা, সুন্দরবনের সম্পদ ব্যবস্থাপনায়, বিশেষ করে সম্পদ ব্যবহার, নবায়ন ও সংরক্ষণে, বিভিন্ন সরকারী কর্মকান্ডে জনগণের ও সুশীল সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের সকল উপাদানসমূহের প্রজনন বা বংশবৃদ্ধি, রোগ-বালাইসহ যে কোন কারণের কোন একটি উপাদানের আধিক্য বা লোপসহ সকল প্রকার পরিবর্তন সঠিকভাবে সনাক্তকরণ ও তা’ প্রতিকার করা, সুন্দরবনের অবক্ষয় রোধকল্পে বনবিদ, শিক্ষাবিদ, গবেষক, পরিবেশবিদ, জাতীয় ও স্থানীয় এনজিও, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও জনপ্রতিনিধি সমন্বয়ে নির্বাহী ক্ষমতাসম্পন্ন সুন্দরবন ওয়াচ গ্রুপ বা সুন্দরবন পর্যবেক্ষক দল গঠন করা।
এ দফাগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রতি বছরই ১৪ ফেব্রুয়ারী সুন্দরবন দিবস পালন করা সুন্দরবন একাডেমির পক্ষ হতে। দাবি জানানো হয় সুন্দরবন দিবসকে জাতীয় স্বীকৃতি দেয়া জন্য। বছরের প্রায় প্রতিটি দিনই বাংলাদেশে কোননা কোন আন্তর্জাতিক দিবস বা জাতীয় দিবস উদযাপিত হচ্ছে। অনেক গুরুত্বহীন বিষয়েও বাংলাদেশে বিভিন্ন দিবস উদযাপন করা হয়। কিন্তু বিশ^ ঐতিহ্যের অংশ এবং বাংলাদেশের জাতীয় বন হয়েও সুন্দরবনের জন্য একটি দিন বরাদ্দ করা গেলনা দীর্ঘ ২ দশকেরও বেশী সময়ে।
খুলনা ঘোষণার মূলমন্ত্রকে উপজীব্য করলে দেখা যায়, সুন্দরবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের জীবন প্রবাহ। সুতরাং এই বনকে রক্ষা করতে হবে এর পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক মূল্য বিবেচনা করেই। কারণ খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় অঞ্চলের কোটি মানুষের উপর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে সুন্দরবনের। এছাড়াও সুন্দরবনকে আবর্তিত করেই যেন গড়ে উঠেছে এখানকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা। তাই এই অঞ্চলের মানুষের বেঁচে থাকার প্রশ্নে সুন্দরবন প্রধান অবলম্বন।
পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, ২১ বছর আগে সুন্দরবন সুরক্ষায় ১৮ দফার আদলে যে কথাগুলো বলা হয়েছে সেগুলো সার্বিকভাবেই সুন্দরবনের জন্য কল্যাণ কর হবে।