‘ঋণ জালিয়াতির মামলার সামারি ট্রায়াল দরকার’

ঋণ জালিয়াতির নামে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঘটছে দুর্নীতির ঘটনা। লুটপাট হচ্ছে ব্যাংকের টাকা। আর এই ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় করা মামলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নাম আসছে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের। কিন্তু ঋণ জালিয়াতির মামলাগুলোর তদন্ত থেকে শুরু করে বিচার শেষ হতে লাগছে দীর্ঘ সময়। এই তদন্ত ও বিচার বিলম্ব নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।আদালত বলেছেন, দ্রুত বিচার পেতে হলে এ ধরনের মামলার সামারি ট্রায়াল (সংক্ষিপ্ত বিচার) করা দরকার। কারণ নিম্ন আদালত, হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগ পর্যন্ত মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে লেগে যাচ্ছে বছরের পর বছর। ফলে বিচারের এই দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ঋণ জালিয়াতির মত দুর্নীতির অপরাধগুলো বারবার সংঘটিত হচ্ছে। যদি দ্রুত বিচার করা সম্ভব হয় তাহলে এ ধরনের অপরাধ রোধ করা সম্ভব হবে। একটি বেসরকারি ব্যাংকের ১৭৬ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির মামলার আসামির জামিন শুনানিকালে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই মন্তব্য করেন।এ পর্যায়ে দুদক কৌসুলির উদ্দেশে হাইকোর্ট বলেন, মামলাটি দ্রুত তদন্ত শেষ করে বিচার শুরুর উদ্যোগ নিন। আমরা (বিচারপতি) একা ফাইট (যুদ্ধ) দিয়ে কি করব? আপনারাসহ যদি সবাই সহযোগিতা না করেন তাহলে কেমনে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব?জাল ওয়ার্ক অর্ডার ও অবৈধ ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে একটি ব্যাংক হতে ১৭৬ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় গত বছরের ৮ জুন দণ্ডবিধির ৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/৪০৯/১০৯ ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলা করে দুদক। মামলায় এরশাদ ব্রাদার্স করপোরেশনের সত্ত্বাধিকারী মো. এরশাদ আলীসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলায় বাকি ১৬ আসামি ওই বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের সাবেক কর্মকর্তা।মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ওই ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন এরশাদ আলী। এই আসামি ব্যাংকের এই শাখা হতে পদ্মা বহুমুখী সেতু কার্যালয়ের এর ঠিকাদার সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেড ও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের নাম করে ছয়টি ভুয়া ও জাল ওয়ার্ক অর্ডারের অনুকূলে ব্যাংক কর্তৃক ১৬৬ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। এই জাল ওয়ার্ক অর্ডারগুলো কোন ধরনের যাচাই বাছাই ছাড়াই ঋণ প্রদানের পক্ষে সুপারিশ করে ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ডিভিশনে (সিআরএম বিভাগ) পাঠানো হয়। পরবর্তীকালে সিআরএম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ওই প্রস্তাব কোন ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই অবৈধ সুবিধা লাভের মাধ্যমে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য ক্রেডিট কমিটি বরাবর প্রেরণ করে। ক্রেডিট কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক পরস্পর যোগসাজশের মাধ্যমে কোন রেকর্ডপত্র যাচাই-বাছাই না করেই ১৬৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা জাল ওয়ার্ক অর্ডারের বিপরীতে ঋণের জন্য অনুমোদন প্রদান করে।এছাড়া এরশাদ কর্পোরেশন ওই শাখা হতে ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে মোট ৭টি ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে দশ কোটি টাকা গ্রহণ করেন। এই ঋণ প্রদান করা হয় ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়াই।এই মামলায় হাইকোর্টে জামিন চান ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা মো. আব্দুর রহিমসহ দুইজন। তার পক্ষে শুনানিতে আইনজীবী তৌফিকুল ইসলাম বলেন, আমার মোয়াক্কেল শুধু ঋণ প্রস্তাব প্রস্তুত করে তা সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রেরণ করেছেন। এছাড়া আর কোন সংশ্লিষ্টতা নাই। এ পর্যায়ে আদালত বলেন, পদ্মা বহুমুখী সেতুর প্রকল্প তো সরকারের। সেখানে বেসরকারি ব্যাংক থেকে কিভাবে ১৭৬ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হলো। অর্থ আত্মসাতের জন্যই এই জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।মামলার সর্বশেষ অবস্থা কী-হাইকোর্ট জানতে চাইলে দুদক কৌসুলি শাহীন আহমেদ বলেন, তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে। এ পর্যায়ে আসামি জামিন পান। আদালত বলেন, সময়মত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হচ্ছে না। ফলে বিচারও বিলম্ব হচ্ছে। তদন্ত ও বিচারে বিলম্ব হলে তো কোর্ট জামিন দিবেই। এ কারণে এ ধরনের দুর্নীতির মামলার দ্রুত বিচার শেষের জন্য সামারি ট্রায়াল দরকার। যাতে মানুষ দ্রুত বিচার পায়। এটা করা গেলে এ ধরনের দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হবে।এ পর্যায়ে আদালত বলেন, ব্যাংক থেকে ১৭৬ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। মামলার অন্য আসামিদের কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না? আমরা একা ফাইট দিয়ে কি করব। দুদকসহ সবাইকে দুর্নীতি প্রতিরোধে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এরপরই হাইকোর্ট আসামির জামিন আবেদনের ওপর আজ আদেশের জন্য দিন ধার্য করে দেয়। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক উপস্থিত ছিলেন।তিনি বলেন, হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ সঠিক। কারণ এ ধরনের দুর্নীতির মামলার তদন্ত ও বিচার যত দ্রুতই শেষ করা যাবে ততই জনমনে স্বস্তি আসবে। যাতে আইনের ফাক-ফোকরে কোন অপরাধী বের হওয়ার সুযোগ না পায়।