মোঃ সাঈয়েদুজ্জামান সম্রাট
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার পর থেকে বেশির ভাগ সময় কেটেছে লড়াই-সংগ্রামে। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্ম নেওয়া দলটির হাত ধরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্র-সবই দেখেছে দলটি। সবকিছু মোকাবিলা করে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলটি টানা এক যুগ ক্ষমতায় রয়েছে। সরকারের উন্নয়ন সহযোগী হিসাবে কাজ করার পাশাপাশি আওয়ামী লীগকে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এখন থেকেই সুসংগঠিতভাবে গড়ে তুলতে চান কেন্দ্রীয় নেতারা। একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধেও সতর্ক তারা। করোনার কারণে পরিকল্পনা অনুযায়ী দল গোছানোর কাজ করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগকে তারা আরও গতিশীল ও বেগবান করতে চান। নতুন করে সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়াচ্ছে দলটি।
একইসাথে দলীয় শৃংখলা ভঙ্গসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের পাশাপাশি বিরোধিতাকারীদের পক্ষ নেওয়া নেতাকর্মীরা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই দলীয় ক্ষমার সুযোগ পাচ্ছেন। দলটির জাতীয় কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীসহ দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত শতাধিক নেতা-কর্মীকে তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ক্ষমা করা হয়েছে। এর বাইরে কেউ থাকলে তারাও আবেদন করতে পারবেন। তাদের বিষয়েও বিবেচনা করা হবে। তবে কোন দায়িত্বশীল পদের কোন ব্যক্তি যদি স্থায়ীভাবে বহিস্কার হন তবে তিনি ক্ষমা চেয়ে আবেদন করলে তার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। তবে তিনি তার পূর্বের পদে বহাল হবেন না। দল করার সুযোগ পাবেন,দলের সদস্য হিসেবে।
একটানা ক্ষমতায় থাকায় দেশের উন্নয়ন হলেও দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্রমে দূরত্ব বাড়ছে। নেতাদের সঙ্গে কর্মীদের যে সংযোগ স্বাভাবিক সময়ে ঘটে, তা ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। এছাড়া স্থানীয় এমপি এবং জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের বিভেদ তো আছেই। এরই মধ্যে তৃণমূল পর্যায়ের বেশির ভাগ কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। আবার যেগুলোর সম্মেলন হয়েছে-এখনও সেগুলো পূর্ণাঙ্গ করা হয়নি। সাংগঠনিক তৎপরতা না থাকায় তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছে হতাশা। তবে এমন পরিস্থিতি আর জিইয়ে রাখতে চায় না আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। দলীয় সভাপতির নির্দেশনায় এ কাজে মাঠে নেমেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটাতে জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও দলীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে তারা প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। সীমিত পরিসরে ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্মেলনের বিষয়েও আলোচনা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে পুরোদমে শুরু হচ্ছে বিভিন্ন কার্যক্রম। এর মধ্যে রয়েছে-নির্বাচনি ইশতেহার প্রণয়ন, প্রার্থী বাছাই ও প্রশিক্ষিত এজেন্ট তৈরিসহ উল্লিখিত সব তথ্য। আরও জানা গেছে, নির্বাচন ও সম্মেলনকে সামনে রেখে এসব কাজ আর ঝুলিয়ে রাখতে চাচ্ছেন না দলটির নীতিনির্ধারকরা। ইতোমধ্যে দলকে নির্বাচনমুখী করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। একই সাথে মাঠেও নেমেছেন সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে কাজের বড় তালিকা ক্ষমতাসীন দলের হাতে।
এরই ধারাবাহিকতায় খুলনা বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হকের নির্দেশে খুলনা জেলার নয়টি উপজেলার মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির কাউন্সিলের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষনা করেছে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগ।
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগকে তারা আরও গতিশীল ও বেগবান করতে চান। জানতে চাইলে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি,জেলা পরিষদের বার বার নির্বাচিত চেয়ারম্যান, সাবেক বিরোধী দলীয় হুইপ, বীরমুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব শেখ হারুনুর রশীদ বলেন, করোনার সময়ও কিন্তু আমরা বসে ছিলাম না। তখন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যতটা করা যায় সাংগঠনিক কাজও এগিয়ে নিয়েছি। এখন করোনার প্রকোপ নেই। এখন আমরা আমাদের সাংগঠনিক তৎপরতা আরও জোরদার করব। আমাদের যে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো রয়েছে, সম্মেলনের মাধ্যমে সেগুলো ঢেলে সাজাব। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের সংগঠনকে আরও গতিশীল, বেগবান করবো। দলীয় সভাপতির নির্দেশনা অনুযায়ী সাংগঠনিক কাজকে আরও গতিশীল করার বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক বলেন, আমরা মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলোকে সম্মেলনের মাধ্যমে ঢেলে সাজাতে চাই। নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা তৃণমূলকে আরও ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে চাই। তারা যেন বিএনপি-জামায়াতের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থেকে নৌকার বিজয়ে কাজ করতে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারী কয়রা উপজেলা সম্মেলন, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২৩ দাকোপ উপজেলা সম্মেলন, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২৩ ডুমুরিয়া উপজেলা সম্মেলন, ২০ ফেব্রুয়ারি ২৩ বটিয়াঘাটা উপজেলা সম্মেলন, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২৩ ফুলতলা উপজেলা সম্মেলন, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২৩ দিঘলিয়া উপজেলা সম্মেলন, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২৩ রূপসা উপজেলা সম্মেলন, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২৩ তেরখাদা উপজেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়াও পাইকগাছা উপজেলার পূর্নাঙ্গ কমিটি অচিরেই বাস্তবায়নেরও নির্দেশনা দেন তিনি।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র ও দলটির নেতারা বলছেন, এখন থেকেই পুরোদমে এই কাজগুলো করে যেতে হবে। কারণ সামনে রোজা রয়েছে। ওই সাংগঠনিক কাজ পুরোদমে চালানো কঠিন। এরপর রয়েছে ঈদের ব্যস্ততা।ফলে সব মিলিয়ে নির্বাচন ও সম্মেলনের প্রস্তুতি শেষ করতে এখনই পুরোদমে মাঠে নামার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলটির নেতারা।
দলটির নীতিনি র্ধারণীয় পর্যায়ের নেতারা জানান-শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ। তবে তৃণমূলের কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা আছে। সেগুলো সমাধানে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে মাঠেও নেমেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। জানতে চাইলে আওয়ামী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট আইনজীবী এ্যাডঃ সুজিত অধিকারী বলেন, আওয়ামী লীগ সুসংগঠিত। এর প্রমাণ করোনাকালে আমরা পেয়েছি। দলের সবাই জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমি মনে করি-এর মধ্য দিয়ে আমরা সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশলী হয়েছি। তিনি বলেন, আমাদের বেশকিছু কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। করোনাকালে আমরা সম্মেলনও করতে পারিনি। এতে কাজে সমস্যা না হলেও নেতৃত্বে কিছুটা সমস্যা হয়। দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে নেতাদের সমন্বয়ে আটটি টিম করে দিয়েছেন। তারা কাজও শুরু করেছেন।আমরাও আমাদের জেলাতে সংগঠনের সাংগঠনিক গতিশীলতা বৃদ্ধি করবার জন্য কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মেনে খুলনা জেলার নয়টি উপজেলায় তিনটি সাংগঠনিক টিমকে দায়িত্ব দিয়েছি।
জানতে চাইলে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সরফুদ্দিন বিশ্বাস বাচ্চু বলেন, যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য যে সাংগঠনিক শক্তি দরকার তা আওয়ামী লীগের আছে। এ শক্তি দিন দিন আরও বাড়বে। সংগঠনকে আরও গতিশীল ও শক্তিশালী করার প্রত্যয়ের কথাও জানান তিনি। এসময় তিনি বলেন,আওয়ামী লীগের টানা এক যুগের শাসনামলে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন দেশ-বিদেশে আলোচিত হয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট পাঠানো হয়েছে। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে সাফল্য এসেছে। জঙ্গি দমনে সাফল্য সারাবিশ্বে আলোচিত। করোনাকালে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সদ্য সাবেক জেলা যুবলীগের বিদায়ী সভাপতি কামরুজ্জামান জামাল বলেন,দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মেনে আমরা সাংগঠনিক সকল কাজ করছি। তিনি আরও বলেন,আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে দুঃসময়ে নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন, তরুণ ও মেধাবীদের সুপথের রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, জঙ্গি নির্মূল, স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার কাজ সম্পন্ন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য মর্যাদা, দেশ ও জনগণের ভাগ্যের আমল পরিবর্তন এবং বিশ্বদরবারে দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগ।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক বলেন, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর হাতকে শক্তিশালী করতে সুদৃঢ় ঐক্য ফিরিয়ে আনতে হবে। আগামী নির্বাচন আমাদের জন্য খুবই চ্যালেন্জিং সেহেতু সকল ভেদাভেদ ভুলে,সকল গ্রুপিংয়ের উর্ধ্বে থেকে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোন বিকল্প নেই। ইতোমধ্যে জাতীয় কমিটি দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া ও দলীয় কোন্দল সৃষ্টির অভিযোগে বহিষ্কার হওয়া শতাধিক নেতার আবেদন গ্রহণ করে ক্ষমা ঘোষণা করেছে।’বিভিন্ন নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী এবং দল মনোনীত প্রার্থীর বিরোধিতা করায় যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে তাদেরও আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি আরও বলেন,এর বাইরে কেউ থাকলে তারাও আবেদন করতে পারবেন। তাদের বিষয়েও বিবেচনা করা হবে। এসময়ে তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে ষড়যন্ত্র চলছে। তাই সবাইকে সতর্ক থাকার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে, দলকে আরও আধুনিক ও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। চিহ্নিত অপরাধী, চাঁদাবাজ, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের কোনো অবস্থাতেই দলে আনা যাবে না। ত্যাগীদের মূল্যায়ন করতে হবে।