আরও চারজনের মৃত্যু
একদিনে শনাক্ত ১৩১

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ মাত্র একদিন আগে খুলনা করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে এ যাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ১২৫জন রোগী ভর্তি ছিল। কিছুটা কমলেও গতকাল রোগীর সংখ্যা ছিল ১১৯। আবার এ যাবতকালের মধ্যে খুলনা মেডিকেল কলেজের আরটি পিসিআর ল্যাবে শতকরা হারের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি করোনা শনাক্ত হয় গতকাল সোমবার। অর্থাৎ গতকাল ৩৭৬টি নমুনা পরীক্ষায় ১৩১জনের করোনা শনাক্ত হয়। রোগী ও নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। রোববার রাত থেকে গতকাল রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত খুলনা করোনা হাসপাতালে চারজনের মৃত্যু হয়। খুলনায় প্রতিদিন যে হারে করোনা রোগী বাড়ছে এবং মৃত্যু হচ্ছে তাতে রীতিমতো আতংক ছড়িয়ে পড়ছে। রোগীর চাপ সামলাতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জনবল ও বেডসংখ্যা বৃদ্ধি করা। পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করাও জরুরি। কিন্তু পাইপ লাইনের মাধ্যমে অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপন কাজ শুরু হলেও এখন পর্যন্ত জনবল ও বেড বৃদ্ধির কোন বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। অথচ সংশ্লিষ্টরা বলছেন বর্তমানে খুলনায় যে হারে করোনা পরিস্থিতি বাড়ছে তাতে এটিকে উচ্চ মাত্রায় সংক্রমণশীল বলা যায়। যদিও গত ২ জুনের করোনাভাইরাস প্রতিরোধ সংক্রান্ত জেলা কমিটির মিটিংয়ে খুলনার সিভিল সার্জন ডা: নিয়াজ মোহাম্মদ বলেছিলেন, খুলনায় করোনা উচ্চমাত্রায় সংক্রমনশীল কিন্তু স্থিতিশীল। তবে গতকাল খুলনা মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ও খুলনা বিএমএ’র সাধারণ সম্পাদক ডা: মো: মেহেদী নেওয়াজ বলেন, এখন আর স্থিতিশীল নেই, বরং উচ্চমাত্রায় সংক্রমনশীল। কেননা যেদিন মিটিং হয় তার পরের দিন থেকে করোনা পরিস্থিতি ক্রমেই বাড়ছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার(আরএমও) এবং করোনা হাসপাতালের মুখপাত্র ডা: সুহাস রঞ্জন হালদার বলেন, রোববার রাত সোয়া ১১টা থেকে গতকাল সোমবার রাত সাড়ে ১১টা পর্যনন্ত এ হাসপাতলে চারজনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে রোববার রাত সোয়া ১১টায় মৃত্যু হয় খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার কৈয়া বাজারের আ: রউফ(৬৫) নামে একজনের। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে ওইদিনই এ হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর গতকাল সকাল সাড়ে ছয়টায় মৃত্যু হয় নগরীর শেরে বাংলা রোডের বাসিন্দা সাবরিনা ইলিয়াস বিথী(১৯) নামে এক রোগীর। তাকে করোনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ৪ জুন। অবশ্য বিথীর পারিবারিক সূত্র বলছে, বিগত প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি লিভারসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। খুলনা, ঢাকা এমনকি দেশের বাইরে নিয়েও তাকে চিকিৎসা করানো হয়। সুস্থ্য না হলে সম্প্রতি তাকে আবারো খুমেক হাসপাতালে ভর্তি করার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ক্যান্সার ধরা পড়ে। কেমোথেরাপী দেয়ার পর আরও অসুস্থ হলে খুমেক হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়। সেখানে আরো কিছু পরীক্ষা করার এক পর্যায়ে করোনা পজেটিভ হয়। এরপর তাকে ৪ জুন করোনা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। হাসপাতালের এইচডিইউতে(হাই ডিপেন্ডসি ইউনিট বা উচ্চ নির্ভরতা কেন্দ্র) রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়। গতকাল সকালে তার মৃত্যু হলে গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে নিয়ে দাফন করা হয়। এছাড়া গতকাল রাত পৌনে আটটার দিকে মৃত্যু হয় আ: গনি শেখ(৭০) নামে এক রোগীর। তিনি বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার গোয়ালমাঠ এলাকার বাসিন্দা। করোনায় আক্রান্ত হয়ে গতকালই তিনি এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। গতরাত সাড়ে ১১টার দিকে রুমিছা খাতুন(৫১) নামের এক রোগীর মৃত্যু হয়। তিনি খুলনার দিঘলিয়া এলাকার বাসিন্দা। করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনি গত ২৮ মে এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।
প্রতিদিনই কারও না কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে করোনায়। সেই সাথে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যাও। গতকাল খুলনা মেডিকেল কলেজের আরটি পিসিআর ল্যাবে ৩৭৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে খুলনার নমুনার সংখ্যা ছিল ৩১৫টি। মোট নমুনার মধ্যে ১৩১জনের করোনা শনাক্ত হয় বলে কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা: মো: মেহেদী নেওয়াজ জানান। এর মধ্যে খুলনার ১১৫জন, বাগেরহাটের আটজন, যশোরের তিনজন, সাতক্ষীরার তিনজন, নড়াইলের একজন এবং মাগুরার একজন রয়েছেন।
করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সেই একশ’ বেডের বেশি যেমন বাড়েনি, তেমনি দেয়া হয়নি চাহিদা অনুযায়ী জনবলও। আগে করোনা হাসপাতালের শুধুমাত্র নিচতলায় রেডজোন, ইয়োলো জোন এবং আইসিইউ ছিল। চিকিৎসক, নার্স, ক্লিনার, আয়াসহ অন্যান্য কারিগরি জনবল যা ছিল তা দিয়ে মোটামুটি সামাল দেয়া যাচ্ছিল। কিন্তু ৩০ মে থেকে মুমূর্ষু রোগীদের জন্য দ্বিতীয় তলায় আইসিইউ ও এইচডিইউ চালু করা হলেও সেজন্য বাড়তি কোন জনবল দেয়া হয়নি। এতে অল্প জনবল দিয়ে বেশি রোগীর চিকিৎসা সেবা দেয়ার ফলে সেখানে কর্মরতরাও খিটখিটে মেজাজের হয়ে উঠছেন। অনেক রোগীর সাথেই ডাক্তার, নার্স, কর্মচারীদের খারাপ ব্যবহার করতে দেখা যায়। এ নিয়ে রোগীর ভিজিটরদের সাথে সেখানে কর্মরতদের প্রায়ই বাক বিতন্ডা হয়। সম্প্রতি মংলার এক রোগীর মৃত্যু হলে তার ছেলে বার বার বিলাপ যাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ডাক্তারদের অবহেলায়ই তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে। এমন অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু কম জনবল দিয়ে সব রোগী সামাল দেয়া আদৌ সম্ভব নয়।
এ ব্যাপারে খুমেক হাসপাতালের করোনা প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা কমিটির সার্বিক সমন্বয়কারী ডা: মো: মেহেদী নেওয়াজ বলেন, গত ২ জুনের জেলা কমিটির মিটিংয়ে জনবল ও বেড বৃদ্ধির জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল। ওই মিটিংয়ে সিভিল সার্জন বলেছিলেন তার আওতায় থাকা ৪০ জন নার্সকে করোনা হাসপাতালে পদায়ন করা হবে। আবার বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে খুলনা বাদে অন্য নয়টি জেলা থেকে দু’জন বা একজন করে ডাক্তার করোনা হাসপাতালের জন্য বদলী করে আনার জন্য বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের প্রতিনিধির ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। সিভিল সার্জনের মাধ্যমে জেলার নয়টি উপজেলা থেকে অন্যান্য জনবল আনার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু তার কিছুই এখন পর্যন্ত হয়নি। যে কারণে পুরো চাপ সামলাতে হচ্ছে খুমেক হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্যদের। ওই মিটিংয়ে করোনা হাসপাতালের দ্বিতীয় ইউনিট খোলার জন্য অবশ্যই জনবল পদায়ন দরকার বলেও মতামত দেয়া হয়। কিন্তু তার কিছুই করা হয়নি।
খুলনা মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবের গত এক সপ্তাহের হিসাবে দেখা যায়, পয়লা জুন করোনা শনাক্ত হয় ২৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ, ২ জুন ২৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ, ৩ জুন ২৯দশমিক ৭৩ শতাংশ, ৪ জুন ২৯দশমিক ২৫ শতাংশ, ৫ জুন ২০ দশমিক ৯২ শতাংশ, ৬ জুন ২৬দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং গতকাল শনাক্ত হয় ৩৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
খুলনার পাশাপাশি বিভাগের করোনার চিত্রও একই। প্রতিদিনই বাড়ছে করোনার রোগী, বাড়ছে মৃত্যুও। বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা: রাশেদা সুলতানা বলেন, বিগত সাত দিনে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২৯জনের মৃত্যু হয়। সেই সাথে গত সাত দিনে শনাক্ত হয়েছে দু’হাজার ১২০জনের। দিনদিন যে হারে করোনা রোগী বাড়ছে ও মৃত্যু হচ্ছে সেটি উদ্বেগের বলেও তিনি মনে করেন। এ অবস্থায় সকলকেই তিনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহবান জানান।