উপকূলবাসীর জীবনচিত্র

এইচ এম আলাউদ্দিন ও শিপন ভূইয়া ঃ একষট্টি বছর বয়সী ছায়গার বেগম একাই থাকেন দাকোপের চুনকুড়ি নদীর পাড়ে। কোন ছেলে সন্তান নেই। দু’টি মেয়ে, তাও বিবাহিত। স্বামীহারা ছায়রা বেগম দাকোপ পৌর এলাকার চুনকুড়ি নদীর পাড়ে একটি কাঁচা ঘর করে থাকলেও সেখানে নেই নিজস্ব টয়লেট ব্যবস্থা। প্রাকৃতিক কাজটি এজন্য সারতে হয় পাশের বাড়িতে গিয়ে। আবার কখনও নদীতেই টয়লেট করেন তিনি। রাস্তা থেকে ঘর পর্যন্ত যেতে হয় বাঁশের সাকো দিয়ে। নদীতে বর্শি দিয়ে মাছ ধরে বিক্রি করাই তার প্রধান পেশা। বর্শি দিয়ে মাছ ধরে বিক্রি করে যে টাকা হয় তার পরিমাণও খুব বেশি নয়। কখনও দৈনিক ৮০ টাকা আবার কোনদিন একশ’ টাকা হয় মাছ বিক্রি করে। তা’ দিয়েই চলে তার সংসার। খাবার পানি আনতে হয় এক মাইল দূরের উপজেলা সদরের পুকুর সংলগ্ন ফিল্টার থেকে। আর নদীর পানি উঠিয়ে তাতে ফিটকারি দিয়েই করা হয় রান্না। ঘরের একাংশ নদীতে ভেঙ্গে গেছে। প্রতিদিনকার জোয়ারের পানিতেই ঘরের মেঝে সমান পানি ছুঁই ছুঁই হয়। এরপর সামান্য ঝড়-বৃষ্টি হলেতো কোন কথাই নেই। আর ঘূর্ণিঝড় হলে সহায় সম্বল যা কিছু সম্ভব তা’ নিয়ে তিনি গিয়ে আশ্রয় নেন উপজেলা সদরের একটি স্কুলে। এভাবেই নদীর সাথেই জীবন চলছে ছায়রা বেগমের।
এমন হাজারো ছায়রা বেগমের করুন কাহিনী রয়েছে বাংলাদেশের গোটা উপকূলজুড়ে। সুন্দরবন সংলগ্ন দাকোপ উপজেলা নয়টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। বলতে গেলে সব ইউনিয়নের বাসিন্দারাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ইউনিয়ন হচ্ছে সুতারখালী ও কামারখোলা। সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, শিবসা নদীর তীরবর্তী সুতারখালী ও তিলডাঙ্গা ইউনিয়ন, পশুর নদীর তীরবর্তী বানিশান্তা, বাজুয়া ও লাউডোব ইউনিয়ন, ঢাকি ও ভদ্রা নদী তীরবর্তী কামারখোলা ইউনিয়ন এবং চুনকুড়ি নদী তীরবর্তী দাকোপ সদর ইউনিয়নের বাসিন্দারা প্রতিনিয়তই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে থাকেন। নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষের টয়লেট ব্যবস্থা নদী নির্ভরই থাকে। এজন্য অনেক সময় দিনের বেলায় প্রাকৃতিক কাজটি অনেকে না করে সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। আবার অনেকে টয়লেটে যাওয়ার ভয়ে পানিসহ অন্যান্য দৈনন্দিন খাওয়া-দাওয়াও কম করেন। পার্শ্ববর্তী বাড়িতে টয়লেট করতে গিয়ে অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থায়ও পড়তে হয় উপকূলবর্তী মানুষদের।
ছায়রা বেগমের সাথে গতকাল কথা হলে তিনি বলেন, নদীর পাশে ঘর করে থাকেন ১৯৮৮ সাল থেকে। স্বামী মারা যাওয়ার পাশাপাশি তার ঘরটি নদীতে ভেঙ্গে গেলে পাশেই রাস্তা ও নদীর মধ্যবর্তী জায়গায় ঘর করে থাকেন। ইতোমধ্যে তার দু’টি মেয়ে বিয়ের হয়েছে। এজন্য সেখানে তিনি এখন একাই থাকেন। কিছুদিন আগে দাকোপের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাকে একটি ছাগল দেন। তা’ থেকে তার আরও চারটি ছাগল হয়েছে। বর্তমানে পাঁচটি ছাগলের পাঁচটি নাম দিয়েছেন। ছাগলগুলোর নাম ধরেই ডাকেন তিনি। তাদেরকে তিনি সন্তানের মতো দেখভাল করেন। নাম ধরে ডাকা মাত্র ছাগলগুলোও সাড়া দেয়। বাঁশের সাকো তিনি নিজে যেমন পার হয়ে ঘরে যান তেমনি ছাগলগুলোও পার হতে পারে। প্রতিদিন বর্শি দিয়ে যে মাছ তিনি ধরেন সেগুলো দাকোপের বাজারে বিক্রি করে যে আয় হয় তা দিয়েই তার সংসার চলে। সব মিলিয়ে নদীর পাড়ে অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে বাস করলেও ছায়রা বেগমের মনে কোন আক্ষেপ নেই। তিনি বলেন, এটাই তার নিয়তি।
দাকোপের সুতারখালী ইউনিয়নের ভদ্রা নদীর একপাশে সুন্দরবন অপরপাশে কালাবগি যাওয়ার রাস্তা। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে করা হয়েছে কাঁচা রাস্তা। ওই রাস্তার বাইরে অর্থাৎ ভদ্রা নদীর পাশেই আইলার পর ঘর বেঁধে থাকেন ২৭ বছর বয়সী সবুজ মন্ডল। বাবা প্রবাশ মন্ডল বয়সের ভাড়ে নূহ্য। সবুজ মন্ডল একাই সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ ও কাকড়া ধরে যে আয় হয় তা’ দিয়েই চলে তাদের পাঁচ সদস্যের সংসার। খুবই কষ্টেশিষ্টে দিন চলে তাদের। খাবার পানি আনতে হয় কয়েক মাইল দূরের একটি পুকুর থেকে। রান্না আর গোসলের কাজটি সারতে হয় নদীর পানিতে। টয়লেটের ব্যাপারে জানতে চাইলে সবুজ মন্ডল ও তার পরিবারের সদস্যরা জানান, পার্শ্ববর্তী বাড়িতে টয়লেট করেন। কিন্তু ঘরের পাশে নদীর সাথে গাছের শিকড়ের সাথে পলিথিন দিয়ে কিছুটা আড়াল করে টয়লেটের জন্য জায়গা করা হয়েছে এমনটিও দেখা যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগতো দূরের কথা স্বাভাবিক জোয়ারের সময়ই ঘরের মেঝে ছুঁই ছুঁই পানি থাকে বলেও জানান সবুজ মন্ডল। আর দুর্যোগের সময় যখন ঘরে পানি ওঠে তখন খাটের ওপর সবাই একসাথে বসেই সময় কাটান। এভাবেই অনেকটা দুর্বিসহ অবস্থায় চলছে উপকূলবাসীর জীবন।
বেসরকারি সংস্থা জাগ্রত যুব সংঘ-জেজেএস’র একটি জরিপে দেখা গেছে, উপকূলের ৫২ শতাংশ নারী প্রতিবেশির টয়লেট ব্যবহার করেন। আর খোলা জায়গায় টয়লেট করার জন্য রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন ১৪ শতাংশ নারী। ১৯ শতাংশ নারী নদীর পানি ভাটিতে শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। এছাড়া শতকরা ৪৬ শতাংশ নারী খোলা জায়গায় টয়লেট ব্যবহার করেন এবং বিকল্প ব্যবস্থা তথা বাঁধ, নৌকায় বা ঝুলন্ত টয়লেটে প্রাকৃতিক কাজ সারেন ২১ শতাংশ নারী।
অর্থাৎ দুর্যোগে নারীদের যে করুন চিত্র সেটি ওই জরিপের ফলাফল থেকেই প্রতীয়মান হয়। বিশেষ করে টয়লেট ব্যবস্থায় নারীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা জরুরি বলেও উপকূলবর্তী মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে। কেননা পুরুষরা অনেক সময় বন-জঙ্গলে কাজের সন্ধানে গিয়ে প্রাকৃতিক কাজটি সারতে পারলেও নারীরা পড়েন বিপাকে।