মোড়েলগঞ্জের ‘সাধক
বাড়ি’র অজানা কাহিনী

এইচ এম আলাউদ্দিন ও এম, পলাশ শরীফ ঃ অদৃশ্য ভাইরাস কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসে সারা বিশ্ব যখন তটস্থ, চিকিৎসা বিজ্ঞান যেখানে হিমসিম খাচ্ছে, করোনা থেকে রক্ষায় ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতেই যেখানে দুই বছর লেগে গেলো ঠিক এমনই এক সময় চিকিৎসার নামে ঝাড়-ফুক এমনকি উদ্ভট কিছু কারুকার্য মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। ‘বাঘের চামড়ার’ কল্পিত চিকিৎসার নামে গ্রামের অতি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে অর্থ। আবার চাকরী দেয়ার নামেও প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে গোটা এলাকার মানুষের বিরাগভাজন হয়েছেন এক কথিত সাধক। এমনকি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিও ওই ব্যক্তিকে ‘লাল শালু’র গল্পের সাথে তুলনা করেছেন। তার পরেও কিভাবে বছরের পর বছর এভাবে প্রতারণা করে যাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে বেরিয়ে আসে নানান তথ্য। আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের একটি পক্ষকে ম্যানেজ করেই তার এই কারবার বলেও অনেকের অভিমত। লেবাসধারী ওই ব্যক্তি বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার পঞ্চকরণ ইউনিয়নের খরইখালী এলাকার বাসিন্দা। তবে দীর্ঘদিন তিনি এলাকার বাইরে থাকলেও হালে এসে নাম পরিবর্তন করে শুরু করেন কবিরাজী।
সরোজমিনে এলাকায় গিয়ে জানা গেলো, আজকের ইব্রাহীম চিশতি এক সময় এলাকায় পরিচিত ছিলেন বেদার মোল্লা হিসেবে। কিছুদিন অবস্থান করেন গ্রামের বাইরে। হটাৎ বাড়ি এসেই নাম পরিবর্তন করে জ্বিন-ভুত তাড়ানোর তদ্বির শুরু করেন। নিজ বাড়িতে আলাদা একটি কক্ষে অন্ধকারে করা হয় এ কারবার। কখনও জ্বিন ছাড়ানোর নামে ঝাড়-ফুক দেয়ার সময় টিনের ঘরে বিকট শব্দ হয়। বলা হয় ‘ওই যে জ্বিন আসছে’। আবার অনেকের বাড়ির মাটি খুঁড়ে বের করে দেয়া হয় তাবিজ। বলা হয় ওই বাড়ি বা মানুষের ক্ষতি করার জন্য মাটি খুঁড়ে তাবিজ রাখা হয়েছিল। জ্বিনের মাধ্যমে তিনি এ সংবাদ জানতে পারেন। আবার কখনও কবরস্থান থেকে বের করা হয় তাবিজ-কবজ। অবশ্য তার এমন কর্মমান্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে এলাকাবাসী বললেন, একদিন ইব্রাহীম চিশতি ও তার ছেলে রাব্বি অন্য এক বাড়ির কবরস্থানে পলিথিনে করে কিছু একটা রাখার সময় একটি ছেলে দেখে ফেলে। এসময় তাকে এটি কাউকে না বলার জন্য বলা হয়। এভাবে নানান ফন্দির মাধ্যমে তার এহেন কারবার চলছে দীর্ঘদিন ধরে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে কথা হয়, সেলিনা বেগম, নাদিরা বেগম, ফরিদা বেগম, জহুর আলী খান, লাল মিয়া হাওলাদার, শহিদুল ইসলাম, কুরছিয়া বেগম, নাছিমা বেগম, মোবারেক মোল্লা, মহিদ হাওলাদার, নুর ইসলাম খান, মোস্তফা মোল্লা, জরিনা বেগমসহ অনেকের সাথে। তারা তুলে ধরেন ইব্রাহীম চিশতির কবিরাজির ফিরিস্তি।
সেলিনা বেগম নামে এক নারী বলেন, তিনি একদিন অসুস্থ হলে স্থানীয় বেদার মোল্লা তথা ইব্রাহীম চিশতির কাছে যান। এসময় তাকে বলা হয়, তাকে কেউ একজন বান মেরেছে। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ক্ষতি করা। তার চিকিৎসার জন্য কিছু তাবিজ কবজ দেয়া হয়। এজন্য তার কাছ থেকে নেয়া হয় কয়েক হাজার টাকা। তার বাড়ির মাটি খুঁড়ে বের করে দেয়া হয় কয়েকটি তাবিজ। তাকে শরীর বন্ধের যে তাবিজ দেয়া হয়েছিল সেটি কিছুদিন পর খুলে দেখা গেলো তার মধ্যে রয়েছে কিছু তুলা। এভাবেই তার সাথে প্রতারণা করা হয়েছে।
সাখাওয়াত মোল্লা নামের এক ব্যক্তিকে বান মেরে ফেলা হয়েছে বলেও জানান স্থানীয় বাসিন্দা লালমিয়া হাওলাদার। তিনি বলেন, বেদার মোল্লা ওরফে ইব্রাহীম চিশতি নিজেকে আজমীর শরীফের খাদেম হিসেবে পরিচয় দেন। কিন্তু সেখানে তিনি গিয়েছেন কি না তার পাসপোর্ট-ভিসা পরীক্ষা করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসা উচিত।
ইব্রাহীম চিশতির বিরুদ্ধে কবিরাজী করার পাশাপাশি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে চাকরি দেয়ার নাম করেও এলাকার অনেকের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। নাছিমা বেগম নামের এক নারী জানান, তার ছেলেকে একটি মন্ত্রণালয়ে চাকরী দেয়ার নামে কয়েক লাখ টাকা নেয়া হয়। এজন্য তাকে একটি ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়। ঢাকায় ওই মন্ত্রণালয়ে যোগদান করতে গেলে ওই নিয়োগপত্র ভুয়া বলে জানানো হয়। পরে বাড়ি ফিরে ওই ছেলে কিছুদিন পর মারা যান।
সম্প্রতি ইব্রাহীম চিশতির কবিরাজীর মাধ্যমে প্রতারণার চিত্র দেখতে সরোজমিনে গেলে আগে থেকেই খবর পেয়ে পালিয়ে যান ইব্রাহীম চিশতি। এসময় অবশ্য গ্রামবাসী বাঁধা দিলে তাদেরকে মারধর করা হয়। তার হামলায় এক নারী আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এ ঘটনায় মোড়েলগঞ্জ থানায় একটি মামলাও হয়। কিন্তু পুলিশ এখনও আসামী গ্রেফতার করতে পারেনি।
পঞ্জেগানা মসজিদকে জামে মসজিদ ঘোষণা দিয়ে এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদেরকেও বিভক্ত করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ওয়াকফবিহীন জমিতে স্থাপিত ওই মসজিদে কয়েক সপ্তাহ জুম্মার নামাজ আদায় করেছেন তার পারিবারিক লোকজন নিয়ে।
এলাকাবাসীর পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও ওই সাধক সম্পর্কে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। পঞ্চকরণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক মজুমদার বলেন, চিশতি ওনার নিজস্ব উপাধি। তিনি এক সময় কৃষিকাজ করে চলতেন। হালে তিনি চিশতি সেজে অনেকের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ নিয়েছেন। মংলা, খুলনা, বরিশালসহ বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ তার কাছে এসেছে। মূলত ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করে তিনি মানুষকে এ ধরনের হয়রানি করছেন। তিনি আলেমও নন, চিশতিও নন, কোন উচ্চ শিক্ষিতও নন। খুলনায়ও তার একটি আড্ডা রয়েছে। সেখানে বসেও মানুষের সাথে প্রতারণা করা হয় বলেও জানান চেয়ারম্যান। তাবিজ দিতে বাঘের চামড়া লাগবে এমন কথা বলে মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেন। বলা হয়, তার বাড়ির পাশে যেহেতু সুন্দরবন, তাই তিনি মাঝে মধ্যে সেখানে যান এবং বাঘের চামড়া আনেন। তবে এজন্য প্রয়োজন অনেক অর্থ। মানুষ তার কথায় বিশ^াস করে টাকা দিয়ে প্রতারিত হন। অনেক সময় নগদ টাকা না নিয়ে একটা গরুর টাকা বা গরু নেয়া হয়। মাসের মধ্যে ছয়টা গরু খাইয়েছেন মানুষকে। কিছু মানুষ আছে খাওয়ার কথা শুনলেই সেখানে যান। অনেক বোঝানোর পরও তারা ফেরে না। এভাবে কিছু মানুষকে গরু খাইয়ে তিনি হাতে রেখেছেন বলেও উল্লেখ করেন আব্দুর রাজ্জাক মজুমদার। করোনার সময় গরু জবাই দিয়ে খাওয়ানোর অভিযোগ তিনি নিজেই থানায় জানিয়েছেন। পুলিশ আসলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
অবশ্য ইব্রাহীম চিশতিকে সরাসরি না পেলেও তার সাথে মোবাইলে কথা হয়। তিনি বলেন, গাছ-গাছরার মাধ্যমে কিছু তিনি কিছু চিকিৎসা দেন। কিছু চিকিৎসা তিনি জি¦নের মাধ্যমে দিয়ে থাকেন। অনেক সাধনা করে তিনি এটি আয়ত্ব করেন বলেও জানান।
ইব্রাহীম চিশতির স্ত্রী বললেন, কাউকে কোন ক্ষতি-টতি করলে আমরা চিকিৎসা করি। তারা মানুষের উপকার করেন, কারো ক্ষতি করেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোন বই-পুস্তক দিয়ে তার স্বামী কবিরাজী করেন না, খাজা মইনুদ্দিন চিশতির সাধনা করেন বলে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা দিশার মাধ্যমেই তিনি চিকিৎসা করেন। তার ছেলে রাব্বী বলেন, কেউ আল্লাহর ওলির খেলাফত দাবি করলেতো অবশ্যই তার সাধনা করতে হয়। তার বাবাও তাই করেন।
অপরদিকে, ইব্রাহীম চিশতির প্রতারনার হাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষার দাবি জানিয়ে এলাকাবাসী সম্প্রতি বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক, পুলিশ, সুপার, র‌্যাব-৬ খুলনার অধিনায়কসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
ইব্রাহীম চিশতির পিতা আয়নাল মোল্লার কাছে সম্প্রতি রোগী সেজে ফোন দেয়া হলে তিনি তার ছেলে ইব্রাহীম মোল্লার মোবাইল নম্বর দিয়ে বলেন, তার সাথে কথা বলে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তবে তিনি কোন টাকা পয়সা নেন না বলেও জানান আয়নাল মোল্লা। এ ব্যাপারে এলাকাবাসী জানান, প্রথমে টাকা নেয়া হয়না বলে মানুষকে সেখানে নেয়া হয়। এরপর বিভিন্ন ফন্দি ফিকিরের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া হয় মোটা অংকের অর্থ।
এ ব্যাপারে মোড়েলগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) মো: মনিরুল ইসলাম বলেন, ইব্রাহীম চিশতির প্রতারণার খবর তার কাছেও রয়েছে। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলার পর তিনি এলাকা ছাড়া। পুলিশ চেষ্টা করছে তাকে গ্রেফতারের। আইনের আলোকেই তার বিরুদ্ধে সবকিছু করা হবে বলেও জানান ওসি।