খুলনার এলপি
গ্যাসের বাজার
এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ লিকুফাইড পেট্টোলিয়াম গ্যাস বা তরলীকৃত গ্যাস বা এলপি গ্যাস। বর্তমানে শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছেও একটি অতি প্রয়োজনীয় জ¦ালানী। আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত এক কেজি গ্যাস পোড়ানোর মানে ১৮ কেজি কাঠ পোড়ানোর হাত থেকে রক্ষা। এজন্য জ¦ালানী গ্যাস পরিবেশবান্ধবও বটে। রাধুনীদের কাছে এর কদরতো রয়েছেই। সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে গ্যাসের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা সরকারের দায়িত্ব। এজন্য সরকারেরই সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বা বিইআরসির মাধ্যমে প্রতি মাসে গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। চলতি মাসের(জুন) জন্য বিইআরসি খুচরা পর্যায়ে এলপি গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করেছে ৮৪২ টাকা। গত পয়লা জুন থেকে যেটি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। খুলনার বাজারে বিইআরসির ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না এমন প্রশ্ন অনেকের। ওই প্রশ্নের জবাব খুঁজতেই গত কয়েকদিন ধরে খুলনার গ্যাসের বাজার ঘুরে দেখা গেলো উল্টো চিত্র। ব্যবসায়ীদের বক্তব্য ‘সরকার গ্যাসের দাম কমায় আর কোম্পানীগুলো বাড়ায়’। পয়লা জুন থেকে যেখানে গ্যাসের পূর্বমূল্যের চেয়ে ৬৪ টাকা কমেছে সেখানে কোম্পানীগুলো থেকে উল্টো সিলিন্ডার প্রতি ৫০ টাকা করে বেশি নেয়া হচ্ছে বলেও জানান এলপি গ্যাস ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে খুলনার বাজারে ১২ কেজি ওজনের সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে সাড়ে নয়শ’ টাকা। অথচ সরকার বা বিইআরসি নির্ধারণ করেছে ৮৪২টাকা। অর্থাৎ প্রতি সিলিন্ডারেই বেশি নেয়া হচ্ছে ১০৮টাকা করে।
গতকাল রোববার নগরীর বয়রাস্থ সাকিল সুপার মার্কেটের আয়ান ট্রেডার্সে গিয়ে দেখা যায় একমাত্র ওমেরা ছাড়া অন্যান্য সকল কোম্পানীর ১২ কেজি ওজনের সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে সাড়ে নয়শ’ টাকা করে। আর ওমেরা কোম্পানীর সিলিন্ডার দাবি করা হয় এক হাজার টাকা। গ্যাসের দাম কমলেও বেশি কেন চাওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে ট্রেডার্সের মালিক সৈয়দ নাজমুল হুদা ত্বোহা বললেন, ‘সরকার টিভিতে দাম কমায়, কিন্তু কোম্পানীগুলোতে বাড়িয়ে দিয়েছে’।
খুচরা পর্যায়ে দাম যেমন বেশি চাওয়া হয় তেমনি কোম্পানীর ওপর দোষ চাপিয়ে পরিবেশকরাও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রেখেছেন বলে বাজার ঘুরে দেখা গেছে। গতকাল বিকেলে নগরীর জোড়াগেটের মেসার্স মাসুম ব্রাদার্সে গিয়ে এলপি গ্যাসের দাম জানতে চাইলে বলা হয়, গ্যাস নেই। সামনেই সারি সারি সিলিন্ডার মজুদ থাকার পরও গ্যাস না থাকার কারণ জানতে চাইলে সেখানকার পরিবেশক জানান, কোম্পানী থেকে দাম বাড়িয়ে দেয়ার কারণে তিনি গ্যাস তুলছেন না। সরকার যেখানে দাম কমিয়েছে সেখানে কোম্পানী কেন বাড়ালো জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটি কোম্পানীর ব্যাপার।
খুলনার গ্যাসে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ক্রেতা বসুন্ধরা কোম্পানীর। এরপর পর্যায়ক্রমে ওমেরা, বিএম, সেনা কল্যান, যমুনা, লাফস ও বেক্সিমকো কোম্পানীর গ্যাস বাজারে চলছে। কিন্তু সাধারণ ভোক্তাদের জন্য মিলছে না সরকারি এলপি গ্যাস।
গ্যাসের মূল্য বেশি নেয়ার কারণ জানতে চাইলে খুলনা এল,পি গ্যাস ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি তোবারেক হোসেন তপু বলেন, বিষয়টি নিয়ে তারাও বিব্রত। একদিকে সরকার দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছে অপরদিকে পরিবেশকরা তাদের কাছ থেকে বেশি দাম নিচ্ছেন। কোম্পানী গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে এমনটি জানিয়ে পরিবেশকরা মূল্য বেশি নিচ্ছেন বলেও তিনি জানান। বিষয়টি সমিতির পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকের সাথে আলোচনা করবেন বলেও জানান। তবে করোনা পরিস্থিতিতে ব্যস্ত থাকার কারনে খুলনার জেলা প্রশাসকের সাথে এখনও সাক্ষাৎ মেলেনি। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা কেনা দামের ওপরই গ্যাস বিক্রি করে থাকেন। সে ক্ষেত্রে তাদের কেনা দাম যদি কম পড়ে প্রয়োজনে তারা সাড়ে নয়শ’ কেনো সাতশ’ টাকায়ও বিক্রিতে প্রস্তুত। এজন্য কোম্পানী ও পরিবেশক পর্যায়ে আগে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত বলেও তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য মো: মকবুল-এ-ইলাহী চৌধুরী বলেন, প্রতিবার মূল্যবৃদ্ধির সাথে সাথেই বিদ্যুৎ, জ¦ালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের কথা জেলা প্রশাসকদের জানিয়ে দেয়া হয়। স্থানীয় পর্যায়ে জেলা প্রশাসকদেরই বাজার মনিটরিং ও তদারকি করার কথা। পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার মাধ্যমে ন্যায্য মূল্যে গ্যাস বিক্রির বিষয়টি নিশ্চিত করে থাকে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শিকদার শাহীনুর আলম বলেন, খুলনায় গ্যাসের মূল্য বেশি নেয়ার অভিযোগ তাদের কাছেও এসেছে। শীঘ্রই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও তিনি জানান।
জাতীয় সম্পদ রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সরদার রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, বিইআরসির মূল্য নির্ধারণের সাথে সাথে সেটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু তারা ক্ষোভের সাথে দেখছেন যে, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের মূল্য বেশি নেয়া হচ্ছে। যেটি গ্রাহকদের সাথে রীতিমতো প্রতারণার শামিল। সুতরাং সরকার শুধু মূল্য নির্ধারণ করেই বসে থাকলে হবে না, বরং এটি কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে।
এদিকে, চলতি মাসের জন্য ১২ কেজির এলপি গ্যাসের মূল্য ৮৪২ টাকা করলেও রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির এলপিজির দাম পরিবর্তন করা হয়নি। সরকারি সাড়ে ১২ কেজি এলপিজির দাম আগের ৫৯১ টাকাই বহাল রাখা হয়।
এর আগে গত ১২ এপ্রিল দেশে প্রথমবারের মতো এলপিজির দাম নির্ধারণ করেছিল বিইআরসি। ওই সময় বলা হয়েছিল, বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে প্রতি মাসে দাম সমন্বয় করা হবে। এরপর ২৯ এপ্রিল একদফা দাম সমন্বয় করা হয়। সর্বশেষ গত ৩১ মে দাম নির্ধারণ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এলপিজি তৈরির মূল উপাদান প্রপেন ও বিউটেন বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। প্রতি মাসে এলপিজির এই দুই উপাদানের মূল্য প্রকাশ করে সৌদি আরামকো। এটি কার্গো মূল্য (সিপি) বা সৌদি সিপি নামে পরিচিত। এই সৌদি সিপিকে ভিত্তি মূল্য ধরে দেশে এলপিজির দাম সমন্বয় করে বিইআরসি। বিগত চার মাস ধরে বিশ্ববাজারে এলপিজির দাম কমছে বলেই আগের মাসের চেয়ে সিলিন্ডারপ্রতি ৬৪ টাকা কমিয়ে এ মাসের জন্য দাম নির্ধারণ করা হয় ৮৪২টা।
অবশ্য গ্রাহকদের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে বারবার বলার পরও বিইআরসি এলপি গ্যামের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে গণশুনানী করতে দেরি করে। সর্বশেষ উচ্চ আদালতের রায়ের কয়েকমাস পর গত বছর(২০২০) ডিসেম্বর মাসে গণশুনানীর মাধ্যমে গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে বিইআরসি। অথচ হাইকোর্ট যখন আদেশ দেয়, তখন গণশুনানী করলে গ্যাসের দাম আরও কমতো বলে মনে করছেন নাগরিক নেতারা কিন্তু বিইআরসি শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থের কারণেই গণশুনানী করতে দেরি করে। আবার এখন মূল্য নির্ধারণ করেও সেটি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।
অপর একটি সূত্র জানায়, গত ডিসেম্বরের গণশুনানীতে বিইআরসি যে ফর্মুলা দেয়, নাগরিক প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে তার কয়েকটি জায়গায় দ্বিমত পোষণ করা হয়েছিল। নাগরিক প্রতিনিধিরা গণশুনানীতে জানান, বিদেশ থেকে ছোট ছোট জাহাজে করে গ্যাস আনার ফলে যেমন খরচ বেড়ে যায় তেমনি এজন্য যেসব বন্দর ব্যবহার করা হয় সেখানেও খরচ বেশি। তাই ছোট জাহাজের পরিবর্তে বড় জাহাজে গ্যাস আনা এবং বন্দর পরিবর্তন করে ব্যায় কমিয়ে আনা যায় কি না সেটিও বিবেচনায় আনার প্রস্তাব দেয়া হয়। সেই সাথে সরকারি সিলিন্ডার বাজারে বাড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধি করা হলে ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া এলপি গ্যাসের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না বলেও মতামত দেয়া হয়।
গণশুনানীতে অংশ নেয়া নাগরিক প্রতিনিধিদের এমন একজন এ প্রতিবেদককে বলেন, ওই প্রস্তাব রাখা হলে সারা বছর গড়ে এলপি গ্যাসের মূল্য সাতশ’ থেকে সাড়ে সাতশ’ টাকা পর্যন্ত রাখা সম্ভব হতো। কিন্তু বিইআরসি নাগরিকদের সে কথা না শুনে তাদের কারিগরি কমিটির কথা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রতি মাসে দাম নির্ধারণ করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যেহেতু দাম ওঠানামা করে সেহেতু যখন গ্যাসের দাম কম থাকে তখন বেশি করে কিনে রাখলে গ্যাসের আরও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব বলেও অনেকে মত দেন।
অপর একটি সূত্র জানায়, বিইআরসির সাথে নাগরিক প্রতিনিধিদের দীর্ঘদিনের মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। যেমন নাগরিক নেতারা বলছেন, যখনই গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হবে তার আগে অবশ্যই গণশুনানী করতে হবে। কিন্তু বিইআরসি সেটি না করে প্রতি মাসে তাদের কারিগরি কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করে। এ ক্ষেত্রে নাগরিক নেতারা বলছেন, প্রতি মাসে না করে বছরে একবার অথবা ছয় মাস পর একবার গণশুনানী করেই দাম নির্ধারণ করা যেতে পারে। তাহলে বার বার দাম নির্ধারণ না করে বছরে একবার বা দু’বার করা হলেই হয়। এছাড়া মান সম্মত গ্যাস সিলিন্ডার, মাপে সঠিক দেয়া, সরকারিসহ সকল কোম্পানীর সিলিন্ডারের গায়ে মূল্য লিখে দেয়া এসব দাবি দীর্ঘদিন ধরে তামাদি হয়েই আছে। যেটি বাস্তবায়ন হলে গ্যাসের মূল্য এক এক ব্যবসায়ী এক এক গ্রাহকের কাছ থেকে এক এক রকম নিতে পারতেন না।