নতুন কমিটিতে নগরে মনা-তুহিন, জেলায় এজাজ-বাপ্পী

এ এইচ হিমালয় ঃ দীর্ঘ ২৭ বছর পর খুলনা মহানগর বিএনপির কমিটি থেকে বাদ পড়লেন নজরুল ইসলাম মঞ্জু। খুলনা নগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক হয়েছেন জেলা সভাপতি শফিকুল আলম মনা। জেলার আহ্বায়ক করা হয়েছে সাধারণ সম্পাদক আমির এজাজ খানকে।
গতকাল ৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার কেন্দ্র থেকে খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপির ৩ সদস্যের করে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়।
খুলনা মহানগর বিএনপির প্রথম যুগ্ম করা হয়েছে নগর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তরিকুল ইসলাম জহিরকে। সদস্য সচিব হয়েছেন নগর ছাত্রদল ও যুবদলের সাবেক সভাপতি শফিকুল আলম তুহিন। জেলা বিএনপির প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক আবু হোসেন বাবুকে। সদস্য সচিব হয়েছেন সিনিয়র সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুল হাসান বাপ্পী। এর মধ্যে তরিকুল ইসলাম জহির ছাড়া অন্য ৫ নেতা দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় রয়েছেন।
গতকাল সন্ধ্যায় নগর ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্যরা নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও সাবেক সিটি মেয়র মনিরুজ্জামান মনির বাসভবনে যান। তারা দল পরিচালনায় তার তাদের পরামর্শ কামনা করেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ মাস ধরেই খুলনা বিএনপির কমিটি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছিলো। নজরুল ইসলাম মঞ্জুর বাদ পড়া নিয়ে গুঞ্জন ছিলো। কিন্তু মঞ্জুবিহীন খুলনা বিএনপির কথা কল্পনায়ও আনেননি বিএনপির শুভানুধ্যায়ী ও তৃণমূল কর্মীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার কমিটি ঘোষণার পর সেই আশংকাই সত্য প্রমাণিত হলো।
বৃহস্পতিবার কেন্দ্র থেকে কমিটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কমিটি প্রকাশের পর সঙ্গে সঙ্গে তা’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। গতকাল দিনভর রাজনৈতিক আড্ডায় আলোচনার কেন্দ্রে ছিলো বিএনপির কমিটি। বিশেষ করে নজরুল ইসলাম মঞ্জু, মনিরুজ্জামান মনি এর বাদ পড়া নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষন হয়েছে। আলোচনা ছিলো সাহারুজ্জামান মোত্তুর্জার না থাকা এবং জেলা থেকে নগর বিএনপির শীর্ষ পদে আসা শফিকুল আলম মনাকে নিয়েও। কমিটির নেপথ্যের ব্যক্তি হিসেবে হাওয়া ভবন ঘনিষ্ঠ এক নেতার নামও উঠে এসেছে আলোচনায়।
গত এক বছর ধরে পৃথক কর্মসূচি পালন করে আসা মঞ্জু বিরোধী অংশের নেতা নতুন কমিটিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সেই তুলনায় বিস্মিত ও অবাক মহানগর, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা। কমিটির বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে দেখা যায়নি। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন সিনিয়র নেতারা।
কমিটি ঘোষণার পর নজরুল ইসলাম মঞ্জুর সব কটি মোবাইল নম্বর বন্ধ। তার অনুসারী হিসেবে পরিচিত সদর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান অপু বলেন, আমরা অবাক বিস্মিত ও হতভম্ব। খুলনায় বিএনপির আন্দোলন সংগ্রাম, সফলতা-ব্যর্থতা যা’ হয়েছে নজরুল ইসলাম মঞ্জুর হাত ধরেই হয়েছে। তাকে বাদ দিয়ে খুলনা বিএনপি কল্পনায়ও আনা যায় না। তিনি বলেন, আগেও অনেকবার নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে তারাই বাদ পড়ে গেছে।
বিএনপির প্রবীণ নেতারা জানান, খুলনায় বিএনপির রাজনীতিতে উত্থান-পতন স্বাভাবিক ঘটনা। নব্বই পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে খুলনা বিএনপির রাজনীতিতে মেরুকরণ হয়েছে। কখনও খুলনা-২ আসনের সাবেক সাংসদ ও সাবেক স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলী, কখনও সাবেক সিটি মেয়র শেখ তৈয়েবুর রহমান, সাবেক হুইপ ও সাবেক সাংসদ আশরাফ হোসেন, সাবেক সাংসদ আলী আজগর লবী এসব মেরুকরণে নেতৃত্বও দিয়েছেন। কয়েকবছর পর দলে আবার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। কিন্তু নেতৃত্ব দেওয়া অনেক নেতাই শেষ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে থাকতে পারেননি। তবে ২৭ বছর ধরে মঞ্জু ছিলেন নিজের অবস্থানে সুদৃঢ়।
সূত্রটি জানায়, ১৯৯২ সালে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর প্রথমবারের মতো নজরুল ইসলাম মঞ্জু প্রথমবারের মতো পদ হারান ২০০৫ সালের ২৫ অক্টোবর। ওই সময় খুলনা-২ আসনের সাবেক সাংসদ আলী আজগর লবীকে আহ্বায়ক এবং সাহারুজ্জামান মোর্ত্তুজাকে সদস্য সচিব করে ১১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। নগর বিএনপির তৎকালীন সভাপতি এম নুরুল ইসলাম দাদু ভাই, সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে করা হয় যথাক্রমে ৪ ও ৫ নম্বর সদস্য। নতুন কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক তরিকুল ইসলাম জহিরও ওই আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন।
কমিটি ঘোষণার দিন থেকেই কমিটি প্রত্যাখ্যান করে পাল্টা কর্মসূচি শুরু করেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত দাদু ভাইকে সভাপতি ও নিজেকে সাধারণ সম্পাদক রেখে সব কর্মসূচি পালন করেছেন নজরুল ইসলাম মঞ্জু। ১/১১ এর কারণে প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর ২০০৮ সালের আগস্টে রাজনীতি শুরু হয়। কিন্তু সাহারুজ্জামান মোর্ত্তুজা ছাড়া বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির অন্য নেতাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
দীর্ঘ আন্দোলন ও রাজপথের ভূমিকা আমলে নিয়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন খুলনা-২ আসনে বিএনপির মনোনয়ন দেওয়া হয় নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে। আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের ওই নির্বাচনে খুলনা বিভাগের দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে নজরুল ইসলাম মঞ্জু বিজয়ী হন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর রাজনৈতিক নেতা থেকে জননেতায় পরিণত হন মঞ্জু। বিএনপির কাগজে-কলমে তখনও তিনি আহ্বায়ক কমিটির সদস্য, নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষের কাছে মহানগর সাধারণ সম্পাদক।
পরের বছরই ২০০৯ সালের ২৫ নভেম্বর সার্কিট হাউজে বর্ণাঢ্য সম্মেলনে নগর বিএনপির সভাপতি করা হয় নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে। সাধারণ সম্পাদক হন মনিরুজ্জামান মনি। সম্মেলনের ঠিক এক যুগ পর কমিটি থেকে ছিটকে পড়লেন তিনি।
মহানগর বিএনপির ১৭১ সদস্যের বিশাল কমিটির অধিকাংশ নেতাই নজরুল ইসলাম মঞ্জু ঘনিষ্ঠ। নতুন কমিটি ঘোষণা ও সার্বিক পরিস্থিতি তারা পর্যবেক্ষণ করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের ৩ জন পূর্বাঞ্চলকে বলেন, আহ্বায়ক কমিটির প্রতিটি সদস্যের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুথানসহ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। অতীতের শিক্ষা কাজে লাগিয়ে বিএনপিকে আরও শক্তিশালী করাই হবে তাদের প্রথম কাজ। তবে মহানগর বিএনপির সিনিয়র নেতাদের বাদ দিয়ে জেলা বিএনপির সভাপতিকে মহানগর আহ্বায়ক করা সঠিক হয়নি। বোঝা যাচ্ছে এটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তির বিরোধিতা করতে গিয়ে, দলের ক্ষতি করার মানসিকতা পরিহার না করলে দল দুর্বল হবে।
বিএনপিপন্থী এক পেশাজীবী নেতা পূর্বাঞ্চলকে বলেন, কোনো পদই কারও জন্য স্থায়ী না। একদিন না একদিন পদ ছাড়তেই হবে। নতুনদের জায়গা দিতে হবে। তবে সময় নির্বাচনটা সঠিক হয়নি। তার ভাষ্য, বিএনপি পরিচালনার পাশাপাশি হাজারো নেতাকর্মীর প্রায় ২০০ শতাধিক মামলা পরিচালনা, আহত-নিহত পরিবারগুলো দেখভাল করা, খুলনায় বিএনপির সামাজিক অবস্থান ধরে রাখা, সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের বিপদে-আপদে পাশে থাকার যে রেওয়াজ নজরুল ইসলাম মঞ্জু চালু করেছিলেন; নতুনদেরও এটা ধরে রাখতে হবে। তাহলে বিএনপির রাজনীতিতে শূন্যতা তৈরি হবে না।