বাংলাদেশে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় একজন সার্জনের বিপরীতে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট আছেন দশমিক ৩৭ জন। আর প্রতি হাসপাতালের বিপরীতে আছেন দশমিক ৪৫ জন। অর্থাৎ প্রতি দুটি হাসপাতালের বিপরীতেও অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট একজনের কম। একইভাবে অন্যান্য দক্ষ জনবলের ক্ষেত্রেও রয়েছে অপর্যাপ্ততা। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালের বিপরীতে সার্জন আছেন ১ দশমিক ২২ জন। আর ল্যাব টেকনিশিয়ান আছেন দশমিক ১৭ জন। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ছয়টি হাসপাতালের জন্য ল্যাব টেকনিশিয়ান আছেন একজন। প্রতি হাসপাতালের বিপরীতে গড়ে দশমিক ৭৭ জন প্যাথোলজিস্ট ও বায়োকেমিস্ট রয়েছেন। আর প্রত্যেক প্যাথোলজিস্ট বা বায়োকেমিস্টের বিপরীতে ল্যাব টেকনিশিয়ান আছেন দশমিক ২২ জন। যারা স্বাস্থ্য খাত নিয়ে খোজখবর রাখেন তারা জানেন, একজন রোগীর অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয় বিশেষজ্ঞ শল্য চিকিৎসকের (সার্জন) তত্ত্বাবধানে। আর শরীরের প্রয়োজনীয় অংশকে অসাড়-অজ্ঞান করার (অ্যানেস্থেসিয়া) মাধ্যমে রোগীকে অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুতের কাজটি করে থাকেন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট। এর পাশাপাশি অসাড় অবস্থায় হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর কার্যকারিতা ঠিক রাখা এবং অস্ত্রোপচার-পরবর্তী সময়ে রোগীর জ্ঞান ফেরানো ও ব্যথা প্রশমনের কাজটিও করেন তিনি। জটিল অস্ত্রোপচার সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি সার্জন ও অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট-দুজনের ওপরই নির্ভর করে। এজন্য গোটা বিশ্বেই স্বাস্থ্য খাতে সার্জন ও অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের পর্যাপ্ততার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশের এ বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। এ জন্য বরাবরই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত চলছে সার্জন ও অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের মতো বিশেষায়িত চিকিৎসকের সংকট নিয়ে। বিশেষ করে দেশের সরকারি স্বাস্থ্য খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোয় এ সংকট তুলনামূলক বেশি প্রকট। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোয় গড়ে সার্জন রয়েছেন একজন। আর গড়ে প্রতি দুটি হাসপাতালের বিপরীতে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট রয়েছেন একজনেরও কম। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের মতো বিশেষায়িত চিকিৎসকের সংকট আরো বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট আছেন দুই হাজারের কাছাকাছি। এর মধ্যে সরকারিতে রয়েছেন প্রায় এক হাজার। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কাঠামোর মধ্যে ৪২৯টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট রয়েছেন ১৪২ জন। এ পর্যায়ের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের পদ খালি ৭০ শতাংশ। দক্ষ এসব জনবলের অভাবে সরকারি হাসপাতালগুলোয় নিয়মিত অস্ত্রোপচার কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে পেশাজীবীদের সংকট ও প্রয়োজন অনুযায়ী সমবণ্টন না থাকায় সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ছে। আবার সরকারির মতো বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানেও অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মারাত্মক সংকট রয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। দেশে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের সংকট মোকাবেলায় কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই বলে মনে করছেন বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিওলজিস্টসের সভাপতি ডা. দেবব্রত বনিক। আমরা মনে করি ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ সরকারের এ নীতিকে বাস্তবায়নে সার্জন এবং অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের অনুপাত একটি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় আনতে হবে। অস্ত্রোপচারে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের ভূমিকা অনেক বেশী। দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট তৈরী করতে হবে। এ জন্য বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করা যায় না যদি কি না অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের অভাব থাকে। ঢাকার বাইরের জেলাসমূহ এবং প্রধানত উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলিতে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের অভাব আরও বেশী, সেজন্য সেখানে সংকটও বেশী। বেশীরভাগ উপজেলায় এ জন্য অস্ত্রোপচারও হয় না। রোগীকে ছুটতে হয় জেলা সদরে। আর অবস্থা জটিল হলে বিভাগীয় শহরে বা রাজধানীতে। এমন অবস্থার অবসান হওয়া উচিত। রাতারাতি হয়তো এ সংকট সমাধান হবে না। তবে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট, ল্যাব টেকনেশিয়ানের মত দক্ষ জনশক্তি তৈরী করতে হবে। তা’ না হলে আমাদের স্বাস্থ্যসেবাকে কাঙ্খিত মাত্রায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। আমরা চাই স্বাস্থ্য বিভাগ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে স্বল্প মেয়াদী, মধ্য মেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। ভবিষ্যত উন্নত বাংলাদেশের আদলে স্বাস্থ্য খাতকে নিতে হলে এখন থেকেই সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে বলে আমরা মনে করি। স্বাস্ব্য সেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। সেই অর্থে স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় জনবল থাকা দরকার। কিন্তু বিশেষ করে হাসপাতালে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট, ল্যাব টেকনেশিয়ানের মত দক্ষ জনশক্তি অপরিহার্য। সেখানে প্রতি উপজেলা হাসপাতালে তো দূরের কথা জেলা শহরের হাসপাতালেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক বড় হাসপাতালে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট, ল্যাব টেকনেশিয়ানের অভাব রয়েছে। এ অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে এসব পদে লোক নিয়োগ করা হোক।