গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীদের অবদান এখন বেশ উৎসাহব্যাঞ্জক। ক্রমেই নারীরা অর্থনীতিতে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করছেন। এটি দেশের সামস্টিক অর্থনীতির জন্য সুখবর। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের প্রাণিসম্পদ খাতে নারীর অংশগ্রহণ ৮৮ দশমিক ২ শতাংশ যেখানে পুরুষের মাত্র ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। এতে দেখা যাচ্ছে দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের প্রধান চালিকা শক্তিই এখন নারী। একঅর্থে গ্রামীণ নারীদের শ্রমে ভর করেই এগোচ্ছে দেশের গবাদিপশু ও পোলট্রির সম্প্রসারণ কার্যক্রম। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনটিতে শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭-এর তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, দেশের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ১৪ দশমিক ৫ শতাংশই প্রাণিসম্পদ খাতের ওপর নির্ভরশীল। আর কৃষি খাতের কর্মসংস্থানের মধ্যে প্রাণিসম্পদ খাতের অংশ ৩৫ শতাংশ। এছাড়া দেশের মোট পুরুষ কর্মসংস্থানের মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাতে কাজ করছে আর নারীদের মোট কর্মসংস্থানের ৪১ শতাংশই প্রাণিসম্পদসংশ্লিষ্ট খাতে। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭-এর তথ্য ব্যবহার করা হলেও বর্তমান সময়ে প্রাণিসম্পদ খাত আরও সম্প্রসারণ হয়েছে। এ খাতের আরও বেশী শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। খাতসংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ পরিবারেই হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু লালন-পালন করা হয়। সাধারণত বাড়ির নারীরাই এগুলোর দেখাশোনা করেন। নারীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হলে সামনের দিনগুলোয় এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে তারা আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন। পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ খাতেও উৎপাদন বাড়বে। এ কথা সত্যি যে, প্রাণিসম্পদ খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেশি থাকলেও এতে মালিকানায় তারা পিছিয়ে রয়েছেন। বাংলাদেশ ইন্টিগ্রেটেড হাউজহোল্ড সার্ভে ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের বড় আকারের গবাদিপশুর (গরু-মহিষ) ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ মালিকানাই রয়েছে পুরুষের হাতে আর নারীর মালিকানায় রয়েছে ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ। আবার ছোট গবাদিপশুর (ছাগল- ভেড়া) ক্ষেত্রে পুরুষের মালিকানায় আছে ৫৩ দশমিক ৮ শতাংশ আর নারীর মালিকানায় আছে ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে হাঁস-মুরগির ক্ষেত্রে নারীর মালিকানা ৮৩ দশমিক ৮ ও পুরুষের ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। সাতক্ষীরা জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ডাক্তার এসএম মাহবুবুর রহমান জানান, পোলট্রি শিল্পে নতুন নতুন নারী উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। এসব নারী সাংসারিক কাজের পাশাপশি পোলট্রি উৎপাদন করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। ‘সামাজিকভাবে আমাদের দেশে পরিবারগুলোর কর্তা পুরুষ। সে কারণে প্রাণিসম্পদ খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেশি থাকলেও পুরুষরাই বেশি মালিকানায় রয়েছেন। এক্ষেত্রে মালিকানার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশীদারত্ব বাড়ানো। সেটাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং তার জন্য বিভিন্ন স্থানে নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে।’ নারীরা পারিবারিকভাবে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি দেখাশোনা করেন। বাড়ির কাজ যেমন অবৈতনিক তেমনি পারিবারিক গবাদিপশু বা হাঁস-মুরগি লালন-পালনও অবৈতনিক। এটা তাদের সম্পূর্ণ কর্মসংস্থান নয়। বৃহত্তর পারিবারিক কাজের অংশ হিসেবেই তারা এটা করে থাকেন। স্বাবলম্বী করতে হলে নারীদের মালিকানা দিতে হবে। কিন্তু পারিবারিকভাবে দেখাশোনা করলে নারীরা মালিকানা পান না। যত বেশি উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের সম্পৃক্ত করা যায় তত বেশি তারা স্বাবলম্বী হবেন। অর্থাৎ নিজের টাকায় গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি কিনতে হবে।’ আমরা মনে করি দেশকে যদি ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ দেশের কাতারে নিতে হয় তাহলে নারীদের শুধু প্রাণিসম্পদ খাতে ধরে রাখলেই চলবে না। নারীদের শিল্পের সকল খাতে সম্পৃক্ত করার মত করে তৈরী করতে হবে। তাদের বিভিন্ন খাতে অবদান রাখার পরিবেশ তৈরী করে দিতে হবে। নারীদের কর্মমুখী শিক্ষার পাশাপাশি তাদের দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে উঠতে আরও বেশী সহায়তা করতে হবে। আমরা মনে করি, গ্রামীণ নারীরা যাতে সরকারের ঐসব কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে নিজেদের দক্ষ করে তুলতে পারে স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে সে উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে সমাজে কম সুবিধাভোগী অনেক নারী রয়েছেন যারা মেধাবী এবং সৃজনশীল। কিন্তু তারা পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগসূত্রের অভাবে তাদের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারে না। আমরা মনে করি এ বিষয়গুলি যদি আরও বেশী করে নজরে আনা যায় তাহলে প্রাণীসম্পদ খাতের পাশাপাশি অন্যান্য খাতেও গ্রামীণ নারীরা অবদান রাখতে পারবেন। আমরা চাই শহরে বসবাসকারী নারী যারা বিভিন্ন কর্মকান্ডে জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন গ্রামীণ নারীরাও সে সব সুযোগ-সুবিধার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করার সূত্রগুলির সাথে সম্পৃক্ত হতে পারবেন- এ ব্যাপারে সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এবং যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমরা মনে করি, দেশে কৃষি খাতে প্রাণিসম্পদ প্রতিপালনে নারীদের মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। নারীদেরকে পৃষ্ঠপোশকতা করা গেলে একদিকে নারীদেও কর্মসংস্থান বাড়তে পাওে এবং তাদেও আর্থিক স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে পারে।