জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত একটি আপদ। দিন যত যাচ্ছে এ আপদের ঝুঁকি ততই বাড়ছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবেব বিশ্বের প্রথম সারির ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। সুতরাং এ বাস্তবতায় আর বলার অপেক্ষা রাখে বাংলাদেশের ঝুঁকি ব্যাপ্তি এবং প্রভাব নিয়ে। সুতরাং সম্ভাব্য এ ঝুঁকি মেনে নিয়েই আমাদের টিকে থাকা এবং জীবনযাত্রার স্বাভাবিক ধারা বজায় রাখার জন্য টেকসই এবং মানানসই অভিযোজন কৌশল গ্রহণ করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবনী চিন্তা কাজে লাগিয়ে জলবায়ুর অভিঘাত কে মোকাবেলা করতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা এবং কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জন্য বিষয়টি খুবই জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি ধান চাষে অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করার পরিবর্তে ন্যুততম এবং প্রয়োজনীয় পানির চাষ পদ্ধতির উদ্ভাবনে নাসার প্রযুক্তির সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। এমনি একটি খবর পত্রিকায় এসেছে। খবরে জানা যায়, চাল উৎপাদনে পানির অপচয় সবচেয়ে বেশি হয় বাংলাদেশে। প্রতি কেজি চালের জন্য পানির ব্যবহার কখনো কখনো ১ হাজার ৩০০ লিটারেও পৌঁছায়। এতে পানি অপচয়ের পাশাপাশি কৃষকের জ্বালানি খরচও হয় প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। দেশের কৃষিতে পানি ও জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে ইন্টিগ্রেটেড রাইস অ্যাডভাইজরি সিস্টেম (আইআরএএস) শীর্ষক একটি মডেল বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় তৈরি মডেলটি কাজে লাগিয়ে জমি ও ফসলে পানির চাহিদা এবং ব্যবহারের মাত্রা নির্ধারণ করতে পারবেন কৃষক। মডেলটি তৈরি হয়েছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার স্যাটেলাইটে ধারণ করা সেচ মানচিত্র ব্যবহার করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশী কৃষকদের অংশীজন হয়ে উঠছে নাসা। জানুয়ারি থেকে জুন-ছয় মাস দেশের বেশির ভাগ কৃষিজমি খরাপ্রবণ হয়ে ওঠে। অথচ এ সময়েই আবাদ করা হয় বোরো ধান, যে মৌসুমে দেশে সবচেয়ে বেশি চাল উৎপাদন হয়। জমি শুষ্ক থাকায় কৃষকদের তখন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। যদিও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকায় বাড়তি সেচের মাধ্যমে তারা প্রয়োজনের চেয়েও বেশি পানি ব্যবহার করেন ধান চাষে। এতে একদিকে যেমন পানির স্তর নেমে যাচ্ছে অন্যদিকে অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যবহারের কারণে কৃষককে গুণতে হচ্ছে বাড়তি খরচ। গবেষকদের দাবি, নাসার সেচ মানচিত্র অনুসরণের মাধ্যমে কৃষকদের আগে থেকেই পূর্বাভাস দেয়া গেলে পানির অপচয় রোধ হবে অন্তত ৩০ শতাংশ। পাশাপাশি জ্বালানির ব্যবহার কমানো সম্ভব ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত। এতে সরকারের ভর্তুকি কমবে প্রায় সাড়ে ১১ কোটি ডলার। এছাড়া বছরে প্রায় তিন লাখ টন কার্বন নিঃসরণও কমানো সম্ভব হবে। প্রকল্পটির সঙ্গে জড়িত গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেচ মডেলটিতে প্রথমে প্রযুক্তির মাধ্যমে চাষের জমিতে কী পরিমাণ পানি রয়েছে তা’ নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি নির্দিষ্ট এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও পূর্বাভাসের সমন্বয়ে মডেলটি প্রস্তুত করা হয়। নাসার স্যাটেলাইটভিত্তিক সেচ মডেলটি ব্যবহারের এ কর্মসূচিতে অর্থায়ন করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতাধীন কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প। ২০১৭ সালে এটি যাত্রা করলেও মূলত ২০২০ সালে এ প্রযুক্তি নিয়ে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কার্যক্রম শুরু হয়। প্রকল্পটির পরিচালক ড. মো. শাহ কামাল খান বলেন, ‘আমাদের দেশে খরার সমস্যা রয়েছে। কৃষক ফসল উৎপাদনে মূলত ঢালাও সেচ দেন। সেচ পাম্প মালিকদের সঙ্গে কৃষক পুরো একটি মৌসুমের চুক্তি করেন। ফলে কৃষক সবসময় চান তার জমিতে যেন পানি ভরপুর থাকে। কিন্তু উৎপাদন ভালো হওয়ার জন্য সবসময় পানি থাকা অপরিহার্য নয়।’ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের দেশের কৃষি নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেসব সংকট কাটিয়ে উঠতে নানা প্রযুক্তির ব্যবহার করছি আমরা। কৃষক শুষ্ক মৌসুমে অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করে থাকেন। প্রযুক্তির মাধ্যমে কীভাবে পানির অপচয় কমিয়ে আনা যায় তা নিয়ে আমাদের কাজ চলছে। কৃষিতে সংকট থাকবে। আবার সংকট উত্তরণে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচিও নিচ্ছি। যার ফলে যত সংকটই থাকুক আমাদের উৎপাদন বাড়ছে।’ আমরা মনে করি কৃষি প্রধানদেশের কৃষি ব্যবস্থায় এ ধরণের উদ্ভাবনী প্রযুক্তি খুবই উপযোগী হবে। তাবৎ কৃষি ব্যবস্থায় যদি পানি ব্যবহার পরিমিত করা যায় তাহলে এটি আমাদের পরিবেশ সুরক্ষায় যুগান্তকারী ভ’মিকা রাখবে। তাই আমরা এই প্রযুক্তি যাতে কৃষক পর্যায়ে সহজবোধ্যভাবে পৌছানো যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। প্রযুক্তিটির উপযোগিতা এবং গুরুত্ব বিবেচনায় মাঠ পর্যায়ে প্রযুক্তিটি হস্তান্তরের জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষের প্রতি আবহান জানাচ্ছি। কৃষির জলবায়ু ঝুকি কমাতে আমরা কৃষিতে টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহারে গুরুত্ব দেয়া পরামর্শ দিচ্ছি। আমরা মনে করি, আমাদের কৃষি নির্ভর এ দেশে কৃষির বিকাশ অব্যাহত রাখতে হবে। কৃষি সমৃদ্ধ হলে দেশ টেকসই হবে। কৃষি ক্ষেত্রে টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। এখন এর ওপর আরও গুরুত্ব দিয়ে আমাদের কৃষিকে স্মার্ট কৃষিতে নিয়ে যেতে হবে।