এ এইচ হিমালয় : পৌষ মাস এলেই হাঁস খাওয়ার ধুম পড়ে নগর জীবনে। শীত আসলেই সরগরম হয়ে ওঠে খুলনার দেশি হাঁস-মুরগির সবচেয়ে বড় বাজার গল্লামারী। বেচাকেনা এবং আয়েশী খাওয়ার মাঝখানে কিছু মানুষ থেকে যায় এ সব আয়োজনের বাইরে। অথচ হাঁস খাওয়ার উপযোগী করে দিতে পরিশ্রমের শেষ নেই তাদের। আর এই কাজ করেই জীবন চলে মানুষগুলোর।
বলা হচ্ছে গল্লামারী বাজারে হাঁস বাছাই কাজে নিয়োজিত নারী-পুরুষের কথা। প্রতিদিন হাঁস কাটা এবং ছেলে দিয়েই সংসার চলে এসব মানুষের।
সম্প্রতি এক সকালে গল্লামারী বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ময়ূর নদীর তীরে সারি সারি চুলা জ্বলছে। সেখানে কাজ করছেন প্রায় ১৫/২০ নারী ও পুরষ। কেউ চুলায় পানি গরম করছেন, কেউ হাঁসের পালক তুলছেন। আবার কেউ আগুন জ্বালিয়ে পশম পোড়াচ্ছেন। আবার কেটে দিচ্ছেন।
গত ৩০ বছর ধরে গল্লামারী বাজারে দেশি হাঁস ও মুরগির ব্যবসা করেন আবুল হোসেন। পূর্বাঞ্চলকে জানান, ময়ূর নদীর শহর অংশে ১৯৯০ সালে ব্যবসা শুরু করেন তারা ৩ জন। হাঁস বিক্রি এবং জবাই করে কেটে-বেছে দিতেন তিনি। গত ৩০ বছরে নদী ভেঙ্গে বড় হয়েছে। এপারে বাজার গড়ে উঠেছে। এখন দেশি-হাঁস মুরগির ব্যবসা করেন ১২ জন এবং এসব হাঁস ও মুরগি কেটে বেছে দেন প্রায় ৩০ জন নারী ও পুরুষ।
আবুল হোসেন বলেন, মুরগি কাটা সহজ হলেও হাঁস সবাই কাটতে পারেন না। বিশেষ করে শহুরে বাড়ির বউরা হাঁস কাটতে পারে না। এজন্য যারা হাঁস কেনেন, তারা এখান থেকে বেছে নিয়ে চান। আমরা গরম পানি দিয়ে সেদ্ধ করে চামড়া ছাড়িয়ে এবং আগুন পুড়িয়ে দেই। চাইলে কেটেও দেই। বর্তমানে নদীর পারে ৯টি দোকানে ১৮ জন এবং ভেতরে আরও ৬/৮ জন এই কাজ করেন।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এই দলে নারীর সংখ্যাই বেশি। তাদেরই একজন নূরজাহান। জানালেন, রাজ হাঁস ও চিনা বড় হাঁস ড্রেসিং করে দিলে ৫০ টাকা, চিনা ছোট ও পাতি হাঁস ড্রেসিং করে দিলে ৩০ টাকা, তারকা মুরগি বড়গুলো ৮০ টাকা এবং ছোটগুলো ৫০ টাকা করে নেন। শীতকালে রাজ ও চিনা হাঁসই বিক্রি হয় বেশি। তাদের কাজের চাপও এ সময় বেড়ে যায়। প্রতিদিন দু’আড়াইশ’ হাঁস বছাই করেন তারা। এই কাজ করেই সারাবছর সংসার চলে তাদের।
২০০১ সাল থেকে হাঁস বাছাইয়ের কাজ করেন আনোয়ারা। সীমার মা হিসেবেই এলাকায় পরিচিত তিনি। নারীদের মধ্যেই তিনি প্রথম এই কাজ শুরু করেন। তিনি জানান, শুরুতে হাঁস বাছাই করে ২ টাকা নিতাম, এরপর ৫ টাকা, ১০ টাকা করে এখন ৫০ টাকা নেই। আমাকে দেখে প্রায় ২০ জনের মতো নারী নতুন করে এই কাজে ঢুকেছেন। তবে মানুষ বেশি হওয়ায় কাজ এখন কমে গেছে।
তিনি বলেন, সারাবছর কাজ করলেও শীতের ৩ মাস কাজের চাপ বেড়ে যায়। তখন হাঁস কেনার ধুম পড়ে। তাদের খাটুনিও বেড়ে যায়। আমরা গরম পানি এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়ে এমনভাবে পরিষ্কার করি, যা বাড়িতে সম্ভব নয়।
বুধবার দুপুরে বাজারে শখ করে হাঁস কিনতে এসেছেন একটি জাতীয় দৈনিকে কর্মরত আল এহসান। প্রতিবেদককে তিনি বলেন, বহুদিন হাঁস খাই না। দোকান থেকে হাঁস কেটে বেছে নিলে বাড়িতে রান্না হবে-গৃহিনীর এই শর্তে হাঁস কিনেছি। ১০০ টাকা দিয়ে হাঁস কেটে-বেছে নিয়ে যাচ্ছি। বাড়ির লোকও খুশি আমিও খুশি।
প্রায় ৫ বছর ধরে এই কাজে নিয়োজিত রওশন আরা নামের আরেক নারী বলেন, আগে বাজারের ভেতরেই কাজ করতাম। কাউকে টাকা পয়সা দিতে হতো না। এখন নদীর পারে দোকানের মতো করে দিয়েছে। কিছুদিন পরে এখানে প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হবে।
অন্যরা জানান, এতোগুলো মানুষ নদীর পারে কাজ করলেও এখানে পানির ব্যবস্থা নেই। গরমের সময় তীব্র রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়। ছাউনি দেওয়া ঘর, বিদ্যুতের ব্যবস্থা এবং একটি নলকূপসহ পানির লাইন থাকলে সবারই উপকার হতো।