সারা দেশে ১০টি অঞ্চলে (জোন) ভাগ হয়ে পরিচালিত হয় সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের কার্যক্রম। এসব অঞ্চলের কোনোটিতে খারাপ সড়কের পরিমাণ বেশি, কোনোটিতে তুলনামূলক কম। সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়নে ২০১৭ সাল থেকে জোনভিত্তিক গুচ্ছ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সওজ। যার একটি আঞ্চলিক মহাসড়ক উন্নয়নে, অন্যটি জেলা সড়কের উন্নয়ন কাজে। তবে এসব প্রকল্পে বরাদ্দ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যেসব অঞ্চলে খারাপ সড়ক বেশি রয়েছে সেগুলোয় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে কম। অন্যদিকে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে থাকা অঞ্চলগুলো পেয়েছে বেশি বরাদ্দ। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও গোপালগঞ্জ- সারা দেশে সওজের সড়কগুলো ভাগ করা হয়েছে এই ১০টি জোনে। এগুলোর মধ্যে ২০১৭ সালে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল কুমিল্লা জোনের আঞ্চলিক মহাসড়ক। সওজের মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এইচডিএম) তথ্য বলছে, সে সময় কুমিল্লা জোনের প্রায় ৪৫ শতাংশ আঞ্চলিক সড়ক ছিল ভাঙাচোরা। তবে এর প্রতিফলন ঘটেনি জোনভিত্তিক আঞ্চলিক সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে। ২০১৭ সালে গৃহীত সওজের আঞ্চলিক সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে কুমিল্লা জোন বরাদ্দ পেয়েছে সবচেয়ে কম। একইভাবে ভাঙাচোরা আঞ্চলিক মহাসড়ক বেশি থাকা সত্ত্বেও উন্নয়ন প্রকল্পে তুলনামূলক কম বরাদ্দ পেয়েছে রাজশাহী জোন। উল্টো ঘটনা ঘটেছে ঢাকা জোনে। এইচডিএমের হিসাবে ২০১৭ সালে ঢাকা জোনের আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোর প্রায় ১৫ শতাংশ খারাপ অবস্থায় ছিল। ভাঙাচোরা সড়ক কম থাকা সত্ত্বেও একই বছর গ্রহণ করা জোনভিত্তিক আঞ্চলিক সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে ঢাকা। একই ধরনের চিত্রের দেখা মিলেছে রংপুর ও খুলনা জোনেও। জোন দুটিতে খারাপ সড়কের পরিমাণ তুলনামূলক কম থাকলেও বরাদ্দ পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা মহাসড়ক মিলিয়ে সওজের অধীনে সড়ক আছে প্রায় ২২ হাজার কিলোমিটার। এই সড়কগুলোর কোনটি কী অবস্থায় রয়েছে, জানতে প্রতি বছর জরিপ চালায় এইচডিএম। এ জরিপের আলোকে সড়কগুলোর উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের উদ্যোগ নেয় সওজ। ২০১৭ সালে এইচডিএম যে জরিপ করেছিল, তাতে আঞ্চলিক মহাসড়ক সবচেয়ে খারাপ ছিল কুমিল্লা জোনে। জোনগুলোর আঞ্চলিক সড়ক উন্নয়নে সর্বনিম্ন ৪৩৬ কোটি থেকে সর্বোচ্চ ৫৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। পরবর্তী সময়ে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন করে কয়েকটি জোনের বরাদ্দ কিছুটা কম-বেশি করা হয়। এইচডিএমের জরিপে সবচেয়ে খারাপ আঞ্চলিক সড়ক কুমিল্লা জোনে। কিন্তু জোনটি আঞ্চলিক সড়ক উন্নয়নে বরাদ্দ পায় ৪৭৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে রংপুর জোনের আঞ্চলিক সড়ক প্রায় ৯৫ শতাংশ ভালো থাকলেও জোনটিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয় সওজ, ৫৯৮ কোটি টাকা। এইচডিএমের সর্বশেষ জরিপের (মে ২০১৯) তথ্য বলছে, কুমিল্লা জোনের আঞ্চলিক সড়কের অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি। এখনো ৩০ শতাংশের বেশি আঞ্চলিক সড়ক রয়েছে ভাঙাচোরা দশায়। শুধু আঞ্চলিক মহাসড়ক নয়, জেলা মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পেও এইচডিএমের জরিপের সঙ্গে বরাদ্দের অসামঞ্জস্য রয়েছে। ঢাকা জোনে ৬ শতাংশের মতো জেলা সড়ক খারাপ অবস্থায় থাকলেও বরাদ্দ পেয়েছে সাড়ে পাঁচশ কোটি টাকা। অন্যদিকে ৫২ শতাংশের মতো জেলা সড়ক খারাপ থাকলেও সমপরিমাণ বরাদ্দ পেয়েছে ময়মনসিংহ জোন। প্রায় ২৫ শতাংশ খারাপ সড়ক নিয়ে সিলেট জোন বরাদ্দ পায় ৪২১ কোটি টাকা। সওজের মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এইচডিএম) গত তিন বছরের (২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯) জরিপ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, খারাপ অঞ্চলের সড়কগুলোর অবস্থা খারাপই থেকে যাচ্ছে। আবার তুলনামূলক ভালো থাকা অঞ্চলগুলোতেও সড়ক অবকাঠামোর তেমন পরিবর্তন হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা এর দায় দিচ্ছেন উন্নয়ন প্রকল্পে অঞ্চলভিত্তিক বরাদ্দের অসামঞ্জস্যতাকে। তবে সেটি মানতে রাজি নন সওজের প্রকৌশলীরা। এইচডিএমের জরিপের সঙ্গে আঞ্চলিক ও জেলা সড়ক উন্নয়নে জোনভিত্তিক বরাদ্দের এই বিপরীতমুখী অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে সওজ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, এইচডিএমের প্রতিবেদনে আমাদের সড়কগুলোর একটা বাস্তব চিত্র উঠে আসে। এর আলোকে সড়কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নে এইচডিএমের জরিপ গুরুত্ব পায় না-এটা ঠিক নয়। আঞ্চলিক ও জেলা সড়ক উন্নয়নে যেসব গুচ্ছ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট জোনগুলোর চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতেই সেগুলোয় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, দেশে জোনভিত্তিক সড়ক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের ফলে আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোর উন্নয়ন ঘটছে। খুলনা-সাতক্ষীরা আঞ্চলিক মহাসড়কের কাজ-এর আওতায় উন্নয়ন হয়েছে। এ সড়কের প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ। এর সুফল পেতে শুরু করেছে মানুষ। তবে এখনও কাজের কিছু অংশ বাকী আছে। আমরা মনে করি, যথাযথ মান নিশ্চিত করাটা এ ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোর যথাযথ মান নিশ্চিত করতে পারলে তা টেকসই হতে পারে। একই সাথে পর্যায়ক্রমে এমন আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা মহাসড়ক নির্মিত হলে তা’ দেশের যোগাযোগ উন্নয়নে গতি সঞ্চার করবে। আমরা জোনভিত্তিক পরিকল্পনা ধরে রেখে বরাদ্দের ক্ষেত্রে সমতা বিধানের গুরুত্বারোপ করা হোক সে প্রত্যাশা করি।