# ১ কোটি অভিবাসীর বাংলাদেশ এখন উচ্চ রেমিট্যান্সপ্রাপ্ত দেশ
# ২০৪১ সালের আলোকবর্তিকা অভিবাসীদের রেমিট্যান্স
# দেশের গ্রামগুলোর বদলে যাওয়ার নেপথ্যের অনুঘটক রেমিট্যান্স
ফারুক আহমেদ।। বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দিয়েছে অভিবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা যা ‘রেমিট্যান্স’ হিসেবে বহুল পরিচিত। গত ১৫ বছরে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অনুসঙ্গ এই রেমিট্যান্স। ১৯৭৭ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হিসেবে বাংলাদেশীদের সংখ্যা ছিল কমবেশী ১৪ হাজার। এ সময় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল মাত্র ৪৯ মিলিয়ন ডলার। আজ বিশ্বের ১৬৮টি দেশে প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশী ‘অভিবাসী’ হিসেবে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তিলতিল করে সমৃদ্ধ করছেন দেশের অর্থনীতির ভিত। এ বিশাল জনগোষ্ঠী বছরে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশী রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন। অভিবাসীদের পাঠানো ক্রমবর্ধমান এই রেমিট্যান্স ২০৪১ সালে সমৃদ্ধ, উন্নত, জ্ঞানভিত্তিক স্মার্ট বাংলাদেশের আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল। জীবনযুদ্ধে নেমে জীবিকার তাগিদে মানুষ বাধ্য হয়ে দেশন্তরী হয়। আর এ দেশান্তরী হওয়া মানুষগুলোর সুন্দর নাম ‘প্রবাসী’ বা অভিবাসী। যারা প্রবাসে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের উন্নয়নে সহযোগিতা করছেন, সেই রেমিট্যান্স যোদ্ধারা জাতির অহংকার।
জানা যায়, বিদেশে কর্মরত কোনও নাগরিক বা ব্যক্তি যখন তার নিজের দেশে প্রিয়জনের কাছে অর্থ স্থানান্তর করে, তখন তাকে ‘রেমিট্যান্স’ বলে। রেমিট্যান্স শব্দটি ‘রেমিট’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘ফেরত পাঠানো’। রেমিট্যান্স শব্দটি হলো বিদেশে কর্মরত ব্যক্তিদের দ্বারা আত্মীয়দের কাছে অর্থ পাঠানো।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ পৃথিবীর একটি জনবহুল দেশ। দেশটির সব সম্পদের চেয়ে বড় সম্পদ হল জনসম্পদ। এই জনসম্পদই দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় ৭৮ লক্ষ প্রবাসী বাংলাদেশী বাস করেন। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বলছে, ৯৫ লক্ষ বাংলাদেশী বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। বেসরকারী জরিপে প্রবাসীর সংখ্যা ১ কোটি। ২০২২ সালেই রেকর্ড সংখ্যক প্রায় ১১ লাখ ১৩ হাজার কর্মী বৈদেশিক কর্মসংস্থানে যোগ দিয়েছেন। বৈদেশিক কর্মসংস্থানে যোগ দেয়া এ বিশাল কর্মীবাহিনী উপার্জিত অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবে অভিহিত। দেশের অর্থনীতিতে অক্সিজেনের মত ভূমিকা রাখছে প্রবাসীদের পাঠানো এই রেমিট্যান্স । কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী রেকর্ড পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চায়নের অন্যতম নিয়ামক এই রেমিট্যান্স।
অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, আমাদের দেশের মানব উন্নয়নে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। এছাড়াও রেমিট্যান্স দেশের উন্নয়নে নানাভাবে বড় অবদান রেখে চলেছে। দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তির অন্যতম একটি খাত রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্স দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করে। এ রেমিট্যান্স আমাদের মোট অভ্যন্তরীণ আয় বা জিডিপির ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ। দেশকে উন্নত দেশের উত্তরণের অগ্রযাত্রায় এগিয়ে রাখতে দিনরাত পরিশ্রম করছেন রেমিট্যান্স প্রেরক প্রবাসী বাংলাদেশীরা।
রেমিট্যান্স-এর গুরুত্ব সম্পর্কে সূত্র জানায়, রেমিট্যান্স একটি পরিবারের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ায় এবং উন্নত জীবনযাত্রার সুযোগ দেয়, যেমন- ভাল খাদ্য, উন্নত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন ইত্যাদি। রেমিট্যান্স একটি দেশের মাথাপিছু আয় এবং জিডিপির মান বৃদ্ধি করে। প্রবাসীদের অর্থ দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সূত্র বলছে, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রির্জার্ভের বড় উৎস হলো রেমিট্যান্স। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। প্রবাসীদের প্রত্যেকেই বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের শুভেচ্ছা দূত। দেশের মর্যাদা এবং ভাবমুর্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন তারা। সরকার প্রবাসীবান্ধব নীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে রেমিট্যান্সকে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত এক তথ্যে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের রেখাচিত্রে দেখা যায়, ১৯৭৬-৭৭ সালে মাত্র ৪৯ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে। ২০০৮-২০০৯ সালে এ পরিমাণ ১৯৮ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৬৪৯ মিলিয়ন ডলার। কালের পরিক্রমায় রেমিট্যান্স প্রবাহে এখন অসম্ভব রকম উন্নয়ন করেছে বাংলাদেশ। তাই বাংলাদেশ এখন একটি উচ্চ রেমিট্যান্সপ্রাপ্ত দেশ। কোভিড মহামারীর পরেও ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪.৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১.০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আসে বাংলাদেশে। এছাড়াও চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশী রেমিট্যান্স অর্জিত হয়েছে।
বর্তমান সময়ে মানুষ উন্নত বেতন, উন্নত জীবনযাত্রার জন্য নিজ দেশ ছেড়ে অন্যান্য দেশে চলে যান কর্মজীবন শুরু করতে। যার ফলে , বিদেশে কর্মরত এবং বিদেশে বাস করা লোকেরা প্রচুর পরিমাণে রেমিট্যান্স আয় করে এবং আয় করা রেমিট্যান্স নিজ দেশে পাঠায়। যত বেশী লোক বিদেশে বাস করে এবং কাজ করে, তত বেশী রেমিট্যান্স দেশের আয় হিসেবে বৃদ্ধি পায়। যখনই দেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধির কথা আসে, তখন এক বাক্যে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিটেন্সের কথা বলতে হবে। দেশের উন্নতি এবং অগ্রগতির প্রধান সোপান রেমিট্যান্স। অর্থনীতিতে অক্সিজেনের মত ভূমিকা রাখে এটি।
সূত্র মতে, বাংলাদেশের শুধু যে শহরেই উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে তা’ নয়, বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিও বেশ শক্ত ভিতের উপর এখন দাঁড়িয়ে। স্বচ্ছলতা ফিরেছে গ্রামের মানুষের। বিদেশ থেকে আসা অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। পুষ্টি ঘাটতি পূরণ হয়েছে। গ্রামের অর্থনীতিতে কর্মচাঞ্চল্য ও গতিশীলতা সৃষ্টিতে প্রবাসীরা বড় ধরণের ভূমিকা রাখছেন। মানুষের জীবন মান আর গ্রামগুলোর বদলে যাওয়ার নেপথ্যে বৈদেশিক কর্মসংস্থান বা প্রবাসী আয় বড় ধরণের অনুঘটক।
দারিদ্র্য বিমোচন এবং খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের ভূমিকা অপরিসীম। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ শুধু তাদের নিজস্ব খানার আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ছাড়াও বহুমাত্রিক প্রভাবের কারণে সার্বিকভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে সঞ্চালিত হচ্ছে, যা স্বাভাবিকভাবেই গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাকে বেগবান করছে। তবে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়াও শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে প্রবাসী পরিবারগুলো অধিক বিনিয়োগ করে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষা, দক্ষতা ও সর্বোপরি মানবসম্পদ উন্নয়নে রেমিটেন্সের ভূমিকা রয়েছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ডায়নামিকসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স কতখানি ভূমিকা রাখে সে বিষয়ে বিভিন্ন পরিসংখ্যান উল্লেখ করে সূত্র বলে, ২০১৬ সালে পরিচালিত এক খানা জরিপ অনুযায়ী প্রবাসী আছে এমন গ্রামে দেখা গেছে সেখানের খানাগুলোতে দারিদ্রের হার কম এবং খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত খরচের পরিমাণ বেশী এবং গ্রামের যেসব খানায় প্রবাসী নেই সে সব খানায় মাসিক ভোগ ব্যয় গড়ে ৩ হাজার ২০৯ টাকা। আর খাদ্য ব্যয় ১ হাজার ৬৮০ টাকা। আর যে খানায় প্রবাসী রয়েছে সে খানায় ভোগ ব্যয় ৫ হাজার ৪০৩ টাকা এবং খাদ্য ব্যয় ২ হাজার ৩৪৫ টাকা। প্রবাসী রয়েছে খানায় শিক্ষা খাতে বার্ষিক গড় ব্যয় ২৫ হাজার ৭৯৭ টাকা। কিন্তু যে খানায় প্রবাসী নেই সেখানে এ ব্যয় ১৬ হাজার ২২২ টাকা। যদিও সময়ের পরিক্রমায় ব্যয়ের এই ব্যবধানে আনুপাতিক হারে এখন অনেক বেড়েছে। তারপরও প্রবাসী প্রভাবিত খানা এবং প্রবাসী বিহীন খানার অর্থনৈতিক ডায়নামিকস এখানে সহজেই বোঝা যায়।
গত ৫ দশকে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে রেমিটেন্স- এর ভূমিকা এখন অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক। প্রবাসের শ্রম বাজার আমাদের শ্রম শক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও কেন্দ্রস্থল হিসেবে ধরা হয়। এ রেমিটেন্স একদিকে সামস্টিক অর্থনীতির ভিতকে শক্তিশালী করছে অন্যদিকে দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, শিশুর পুষ্টি ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।