# জলাধারগুলো সংরক্ষণের আহবান নাগরিক নেতাদের
# ভ্রাম্যমাণ ট্যাংকির মাধ্যমে পানি সরবরাহের দাবি
# ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমানোর আহবান

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ বিশ^বিদ্যালয়ে পড়–য়া বড় ছেলের টিউশনির আয়ে সংসার চলে এক নারীর। ছোট ছেলে ১০ম শ্রেণির ছাত্র। তিন জনের সংসারে পানির চাহিদা মেটাতে হয় ওই মাকেই। তাইতো কাকডাকা ভোরে কলস নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। থাকেন নগরীর দক্ষিণ টুটপাড়ার একটি বাড়িতে। গতকাল সোমবার সকাল ছয়টায় জোড়াকল বাজারের পাশের ‘শান্তিনিকেতন’ নামের একটি বাড়ির সামনে লাগানো সাবমার্সিবল টিউবওয়েলের ট্যাব থেকে পানি নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। নিজের নামটি প্রকাশ করতে চাননি। তবে পানির কষ্টের কথা জানালেন। বলেন, কলসে একটু পানি ছিল। অন্য একটি পাত্রে ঢেলে রেখে এসেছি। এখন এই এক কলস দিয়েই চালাতে হবে সারাদিন। তিনি যে বাড়িতে থাকেন সেখানে টিউবওয়েলে পানি ওঠে না বলে এখানে এসেছেন।
পাশ দিয়ে পানি নিয়ে তিন নারী যাওয়ার সময় নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতা করছিলেন এভাবেই ‘কি যে করবো, দোতলা পর্যন্ত কি জল নিয়ে ওঠা সম্ভব ? ছিলাম নিচতলায় ভালোই ছিলাম’।
পাঁচটা ৫৬ মিনিটের সময় পানি নিয়ে যাচ্ছিলেন সুধারানী চক্রবর্তী। নিজে দর্জি কাজ করেই সংসার চালান। স্বামী-স্ত্রী দু’জনের সংসারে খাওয়া, রান্না আর ব্যবহারে যে পানি লাগে তা’ তাকে তিনটি জায়গা থেকে সংগ্রহ করতে হয়। জোড়াকল বাজারের শান্তি নিকেতনের সামনে থেকে তিনি বোতলে করে পানি নিয়ে বাসায় কলসে রাখেন। এক কলস পানি ভরতে তার কয়েকবার আসা-যাওয়া করতে হয়। তার পরেও বড় পাত্র বহনের কষ্ট এড়াতে তিনি এমনটি করেন। ওই পানি দিয়ে তিনি রান্না করেন। পাশর্^বর্তী তার জা’এর বাড়ি থেকে আনেন খাবার পানি আর পাশের বাড়ির সাপ্লাই পানি এনে গোসল ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করেন। পানির এই চাহিদা মেটাতেই প্রতিদিন সকালে তার ব্যয় হয় দেড় থেকে দুই ঘন্টা।
সকাল পাঁচটা ৪৮ মিনিটে টুটপাড়া গাছতলা মন্দিরের সামনের দক্ষিণ টুটপাড়া এক নম্বর ক্রস রোডের টিউবওয়েলে কয়েক চাপ দিয়ে যখন পানি উঠছিল না তখন একটি কলস ও দু’টি বোতল নিয়ে শিপ্রা নামের এক নারী অনেকটা বিরক্ত হয়েই হাঁটেন জোড়াকল বাজারের সেই শান্তি নিকেনের সামনে। সাব মার্সিবলের মাধ্যমে ওঠানো পানি থেকেই ট্যাব ছেড়ে নিয়ে আসেন পানি। চার জনের সংসারে একদিন ওই পানিতে হয় না। তার পরেও কষ্ট করে চলতে হবে বলে জানালেন তিনি।
একই টিউবওয়েলে পাঁচটা ৫২ মিনিটে দু’নারী এসে পানি ওঠানোর জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু না ওঠায় ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান। পানিতো উঠলো না এখন কি করবেন-এমন প্রশ্নের জবাবে অনেকটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে বললেন, ‘এখন আর কি করার, যাদের সাব মার্সিবল আছে তাদের ওখানে যেতে হবে’।
একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরী করেন রমা দাস। তিনিও পাঁচটা ৪৪ মিনিটে আসেন ওই টিউবওয়েলে। ভোর চারটার আগে থেকেই তাদের বাড়ির মটর চালু করেও যখন পানি উঠছিল না তখনই তিনি আসেন ওই টিউবওয়েলে। কিন্তু না পেয়ে তাকেও ফিরে যেতে হয়। তিনি বলেন, আগের দিন অল্প কিছু পানি উঠেছিল এই টিউবওয়েলে। আজ মোটেও উঠছে না। একই সাথে এসেছিলেন একই বাড়ির ভাড়াটিয়া গৌরি সাহাও। তাদের দু’জনের বক্তব্য ‘বাড়ির কলে পানি না ওঠার বিষয়টি বাড়ির মালিককে জানাতে হবে’।
টুটপাড়া গাছতলা মন্দিরের সামনের রাস্তায় টিউবওয়েলের দিকে তাকিয়েছিলেন ববিতা মল্লিক নামের এক বৃদ্ধা। অনেকেই যখন চেষ্টা করে পানি না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন তখন তিনি বললেন, সাড়ে চারটার দিকে তিনি নিজেও চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু পানি পাননি।
অন্যের বাড়িতে কাজ করেন লিলি। তিনিও চেষ্টা করে পানি না নিয়েই ফিরে যান। এই টিউবওয়েলে এতোদিন সকালে কিছুটা পানি উঠতো। তাই ভোর থেকে সকাল ৬/৭টা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে নারীরা পানি নিত বলেও জানান তিনি। আগের দিন থেকে ওই কলেও পানি ওঠে না বলে ভিড় কম।
চম্পা নামের এক নারীও ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে দু’মিনিট চেষ্টা করেও পানি উঠাতে ব্যর্থ হন। ছয় জনের সংসারে খাবার জন্য এক কলস পানি নিয়ে সারাদিন হিসাব করে চলতে হয়। সকালে ছাড়া টিউবওয়েলে পানি পাওয়া যায় না বলে তিনি তখন আসেন। কিন্তু পেলেন না। এখন বিকল্প ব্যবস্থায় পানি সংগ্রহ করতে হবে।
পাঁচ জনের সংসারে খাবার ও রান্নার জন্য প্রতিদিন দু’কলস পানি লাগে তৃপ্তি নামের এক গ্রহবধূর। একদিন আগে থেকে তাদের বাড়ির টিউবওয়েলে পানি ওঠে না বলে দক্ষিণ টুটপাড়া এক নম্বর ক্রস রোডের ওই টিউবওয়েলটিতে আসেন তিনি। কিন্তু সেখানেও পানি না পেয়ে ফিরে যেতে হয় তাকে। বিকল্প ব্যবস্থায় তিনিও ভর করবেন পাশের বাড়ির সাব মার্সিবলের ওপর।
রান্না আর খাবারের জন্য দৈনিক ৫/৬ কলস পানি লাগে কল্পনা রানীর। জোড়াকল বাজারের পাশের ট্যাব থেকে তিনি ২/৩ কলস যা পারেন নেন। বাকীটা রাতে নেন তার পুত্রবধূ।
এভাবে নগরজুড়ে যখন পানির সংকট তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীদেরকেই দেখা যায় হা-হুতাশ করে সকালে এ কল থেকে সে কলে ছুটে বেড়াতে।
টুটপাড়া ঘোষের ভিটা এলাকার একটি টিউবওয়েলে গিয়ে সকাল সোয়া ছয়টায় দেখা যায় ৫/৬জন নারী পানির জন্য অপেক্ষা করছেন। একজনের একটি কলস ভরতে সময় লাগে আট থেকে ১০ মিনিট। বাকীরা দাঁড়িয়ে আছেন। এমন সময় মো: ইকবাল হোসেন নামের এক ব্যক্তি কলস নিয়ে আসেন সেখানে। দু’জনের সংসারে এক কলসেই রান্না ও খাবারে দিন চলে। এ প্রতিবেদককে তিনি জানালেন, ফজরের পর একটু শুয়েছিলেন। হঠাৎ মনে হলো দেরি হলেতো পানি উঠবে না টিউবওয়েলে। তাই দ্রুত তিনি কলস নিয়ে সেখানে আসেন। যদিও নারীদের দীর্ঘ লাইন দেখে তিনিও ফিরে যান পানি না নিয়েই।
ওই টিউবওয়েলে ভিড় দেখে পাশের গলির অন্য টিউবওয়েলে চলে যান আর এক নারী। সেখানেও তিনি একজনের চেষ্টার সাথে শামিল হন। টিউবওয়েল থেকে ওঠা পানির পুরোটুকুই যাতে কলসে পড়ে সেজন্য তিনি ওই নারীকে সাহায্য করেন। মিনিট দশেক চেষ্টার পর এক কলস পানি নিতে পারেন তিনি।
এভাবে নগরীর টুটপাড়া থেকে পূর্ব বানিয়াখামার, দোলখোলা, মুসলমানপাড়া, বসুপাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেছে পানির সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে নগরবাসীকে। আলাপচারিতায় এক নারী জানালেন, পানির এই কষ্ট চলবে আরও ২/৩মাস। বৃষ্টি হলেই হয়তো ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর উঠে আসবে।
তবে নগরবাসীর এই পানি সমস্যা সমাধানে কিছু মানুষ জোড়াকল বাজারের শান্তিনিকেতনের ন্যায় এগিয়ে এসেছেন। নিজেদের বাড়ির পানির ট্যাংকি থেকে একটি বা দু’টি লাইন টেনে রাস্তার পাশে ট্যাব বসিয়ে দিয়েছেন অনেকে। যেখান থেকে পানি নিয়ে অনেকেই চাহিদা মেটাচ্ছেন। কিন্তু ওই পানি অন্য কাজে ব্যবহার করা গেলেও অনেক সময় খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। তার পরেও কেউ কেউ ঝুঁকি নিয়ে পান করছেন তা’। বিশেষ করে হোটেল রেস্তোরাঁয় অহরহ ওই পানি ব্যবহার হয় খাবার পানি হিসেবে।
পানি অধিকার কমিটির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ববি বলেন, খুলনাবাসীর দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল হলেও খুলনা ওয়াসা নগরবাসীর পানির চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। বরং মধুমতি থেকে বিদেশী ঋণ নিয়ে যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কয়েক বছর পর সে পরিকল্পনায়ও ভুল ছিল এটিই প্রমাণিত। এজন্য তিনি যে কোন পরিকল্পনা গ্রহণের আগে তার স্থায়িত্ব যাচাই করার আহবান জানান।
পাশাপাশি তিনি নগরবাসীকেও দায়িত্বশীল হওয়ার আহবান জানান। প্রয়োজন হলেই গভীর নলকূপ বা সাবমার্সিবল বসানো হলে ভবিষ্যৎ আরও ভয়াবহ হতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নেয়ার আহবান জানান তিনি।
পানি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা বেসরকারি সংস্থা এ্যাওসেড-এর নির্বাহী পরিচালক শামীম আরেফীন পানি সংকট মোকাবেলায় স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণের আহবান জানান। বছরের যে কয়মাস ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়, টিউবওয়েলে পানি ওঠে না সেই কয়মাস ভ্রাম্যমাণ ট্যাংকির মাধ্যমে কমিউনিটিতে পানি পৌঁছে দেয়া যেতে পারে বলেও মত এই উন্নয়নকর্মীর। এজন্য সিটি কর্পোরেশন, খুলনা ওয়াসা, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসা উচিত বলেও তিনি মনে করেন।
এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখনই শহর ও শহরতলীর সকল প্রকার জলাধারগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। পাশাপাশি বৃষ্টির পানি ভূ-গর্ভে যেতে যেসব বাধা রয়েছে সেগুলো অপসারণ করা, অপ্রয়োজনীয় গভীর নলকূপ ও সাবমার্সিবল নিষিদ্ধ করা এবং অতিমাত্রায় পানি উত্তোলন ও অপচয় রোধ করতে পদক্ষেপ নেয়া হলে ভূ-গর্ভের পানির সংকট কমানো সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি।
খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: আব্দুল্লাহ পিইঞ্জ বলেন, আপৎকালীন পানি সরবরাহের জন্য তাদের আপাতত কোন পরিকল্পনা নেই। তবে অনেক সময় কোন বস্তি বা নিম্নবত্ত এলাকায় পানির সংকট দেখা দিলে তাদেরকে জানানো হলে তাৎক্ষণিক সাময়িক সময়ের জন্য পানি সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এছাড়া গভীর নলকূপ স্থাপনের ক্ষেত্রে ফি নেয়ার বিষয়টি খুব একটা কার্যকর না হলেও যেসব এলাকায় এখনও ওয়াসার লাইন যায়নি সেসব এলাকার ক্ষেত্রে ওই বিধান শিথিল করা আছে। তবে যেসব এলাকায় ওয়াসার লাইন আছে সেখানে গভীর নলকূপ বসানো হলে তা’ বন্ধ করা হচ্ছে। এছাড়া সাবমার্সিবল স্থাপনের ক্ষেত্রে নগরবাসীকে বিভিন্নভাবে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।