# আজ প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাচ্ছে সারসংক্ষেপ
# পদ্মা সেতুতে গাড়ির ট্রায়াল রান বৃহস্পতিবার

আসাদুজ্জামান বিকু॥ আগামী জুন মাসে অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে। বহুল প্রতীক্ষিত এই সেতু চালুর দিনক্ষন চূড়ান্ত না হলেও সম্ভাব্য উদ্বোধনের তারিখ হিসেবে ২৫ জুন আলোচনায় রয়েছে। তাই শেষ মূহুর্তে দেশবাসীর আবেগের এই সেতু উদ্বোধনের প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। যানচলাচলের জন্য সেতু উন্মুক্ত হওয়ার খবরে পদ্মার দুই পড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ।
সেতু প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী বৃহস্পতিবার সেতুতে গাড়ির ট্রায়াল রান হবে। চলতি মে মাসের মধ্যেই সেতুতে আলো জ্বালানোর জন্য পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। জুনের ১৫ তারিখের মধ্যে সব কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। উদ্বোধন হওয়ার পরও টুকিটাকি যে কাজ বাকি থাকবে সেগুলো করা হবে। পদ্মা সেতু উদ্ধোধনের সারসংক্ষেপ আজ রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া তারিখ অনুযায়ী পদ্মা সেতু শিগগিরই উদ্বোধন করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। অপরদিকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম গতকাল শনিবার বলেছেন, পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। আগামী মাসের শেষ সপ্তাহে পদ্মা সেতু খুলে দেওয়া হবে।
সেতু বিভাগ সূত্র বলছে, জুনের শেষ সপ্তাহে সেতু উদ্বোধনের বিষয়টি চূড়ান্ত। তবে উদ্বোধনের দিন হিসেবে কোন তারিখ বেছে নেওয়া হবে, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ইতিমধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে জেনে নিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক সম্মতি পাওয়ার পরই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের দিন-তারিখ ঠিক করে অনুমোদনের জন্য আজ রোববার সারসংক্ষেপ পাঠানো হবে। সে অনুযায়ী উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র তৈরি, মঞ্চ প্রস্তুত এবং অন্যান্য প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করা হবে। সেতু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, তাঁরা ২৫ জুন সেতু উদ্বোধনের সম্ভাব্য তারিখ ধরে এগোচ্ছেন। দু-এক দিনের মধ্যেই বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যাবে। সরকারি সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত থেকে সেতু উদ্বোধন করে গাড়িতে চড়ে সেতু পার হয়ে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে যাবেন। সেখানে আরেক দফা আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নেবেন। পরে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়িতে জনসভা করার কথা রয়েছে। এর মধ্যে গত রোববার সেতু বিভাগের কর্মকর্তা ও প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) কর্মকর্তারা প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের জন্য ম্যুরাল ও ফলক নির্মাণের কাজ চলছে। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে ৪০ ফুট উচ্চতার দুটি ম্যুরাল নির্মিত হচ্ছে। দুটি ম্যুরালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি থাকবে। এর পাশে নির্মাণ করা হচ্ছে উদ্বোধনী ফলক।
আগামী ৩০ মের মধ্যে পদ্মা সেতুতে বিদ্যুৎসংযোগ পাওয়া যাবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে ৩১ মে বা ১ জুন থেকে রাতে সেতুর ল্যাম্পপোস্টগুলো আলো ছড়াবে। ১৫ মে মুন্সিগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে পদ্মা সেতুতে বিদ্যুৎসংযোগ দেওয়ার জন্য চিঠি দেয় পদ্মা সেতু প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে বলা হয়, ৩০ জুনের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হবে এবং এর মধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য সেতুটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে মূল সেতুতে ৮০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ৩০ মের মধ্যে সরবরাহ করতে হবে। এই বিদ্যুৎসংযোগের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে জমা দেওয়া হয়েছে। একই দিন একইভাবে শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকেও চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে। পদ্মা সেতুতে মোট ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্ট বসানো হয়েছে। এর মধ্যে মূল সেতুতে ৩২৮টি, জাজিরা প্রান্তের উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) ৪৬টি, মাওয়া প্রান্তের ভায়াডাক্টে ৪১টি ল্যাম্পপোস্ট বসানো হয়েছে। গত ১৮ এপ্রিল এসব ল্যাম্পপোস্ট ও এর মধ্যে বাতি লাগানোর কাজ শেষ হয়। এরপর পুরো সেতুতে কেবল টানা হয়েছে। গত বছর ২৫ নভেম্বর মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে প্রথম ল্যাম্পপোস্ট বসানোর কাজ শুরু হয়েছিল।
এদিকে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান জাঁকজমকপূর্ণভাবে আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে সেতু বিভাগ। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে দুটি অনুষ্ঠান হবে ধরে নিয়ে সেতু বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে ১৮টি উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে দাওয়াত দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত কমিটি দাওয়াত কার্ডের নকশা ও সজ্জার কাজ শুরু করে দিয়েছে। মনোরম ভেন্যু, সাজসজ্জা, আসন ব্যবস্থাপনা ও অতিথিদের অভ্যর্থনার জন্য রয়েছে কমিটি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভিডিও প্রদর্শনী থাকবে। অতিথিদের দেওয়া হবে উপহার, স্যুভেনির। এর জন্যও কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতিথিদের মাওয়া ও জাজিরা, দুই পাড়েই আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হবে। আর এই কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য কমিটি করা হয়েছে। এ ছাড়া করোনাকালে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য দুই পাড়েই একাধিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেতু বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য, বিশিষ্ট রাজনীতিক ছাড়াও বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা উপস্থিত থাকবেন। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর আগে থেকেই এই প্রকল্প দেশে-বিদেশে আলোচিত। এ জন্য অনুষ্ঠান যতটা সম্ভব আকর্ষণীয় করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ছোটকন্যা ও প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানাসহ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্য সদস্যরাও এ সময় উপস্থিত থাকতে পারেন। এ সেতুর কাজ দেখতে গিয়ে এর আগে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, দুই বোন প্রায় দুই কিলোমিটার সেতুর ওপর হেঁটেছেন। সেতুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুই বোন দীর্ঘক্ষণ গল্প করেছেন। এরও আগে প্রধানমন্ত্রী গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত করতে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে আসা-যাওয়ার পথে নিজে মোবাইল ফোনে সেতুর ছবি তুলেছেন দু-তিনবার।
এদিকে স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের জন্য মুখিয়ে আছে পুরো দেশ। উচ্ছ্বসিত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলার মানুষ। শুক্রবার পদ্মা সেতু এলাকায় গিয়ে এবং আশপাশের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন প্রায় প্রতিদিনই শত শত মানুষ পদ্মা সেতু দেখতে আসছে। এ নিয়ে আলোচনায় মুখর পদ্মা সেতুর দুই পাড়। সেতুর আশপাশের বাসিন্দাদের মনেও আনন্দ। কথা হয় শিমুলিয়া ঘাটে ব্যবসায়ী আব্দুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ পদ্মার পাড় একসময় অবহেলিত জনপদ ছিল। মানুষ এখানে তেমনটা আসত না। এখন আপার (প্রধানমন্ত্রী) জন্য এই এলাকা খুব দামি হয়ে গেছে। এই এলাকার আশপাশে যাদের জমি ছিল তারা আজ কোটিপতি। আমার পরিবারও অল্প জায়গার বিনিমিয়ে সরকার থেকে দুই লাখ হাজার টাকা পেয়েছে। এলাকার উন্নয়নের জন্য আপাকে ধন্যবাদ জানাই। শুধু আব্দুর রহমান নন, তার মতো অন্য সবারও একই কথা। শরিফুল ইসলাম নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, পদ্মাসেতু চালু হলে ঘাটে আর মানুষের কষ্ট করে ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। ফেরিতে উঠতে এবং নামতে যে সময় লাগে, তারচেয়ে কম সময়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে পারবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লাখো মানুষ।
এদিকে গত মঙ্গলবার পদ্মা সেতুতে পারাপারে যানবাহনের শ্রেণিভেদে টোলহার প্রকাশ করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। সরকার নির্ধারিত হার অনুসারে, পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে মোটরসাইকেলের টোল হবে ১০০ টাকা। কার-জিপের টোল ৭৫০ টাকা। বড় বাসের টোল দিতে হবে ২ হাজার ৪০০ টাকা। মাঝারি ট্রাক পারাপারে লাগবে ২ হাজার ৮০০ টাকা। এই সেতু দিয়ে অটোরিকশা, হিউম্যানহলার কিংবা নসিমন-করিমন চলতে দেওয়া হবে না।
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলা সরাসরি সারা দেশের সঙ্গে যুক্ত হবে। আগেই ঢাকা-ভাঙ্গা রুটে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ফলে এই পথে যাতায়াতের সময় কমে এক ঘণ্টায় নেমে আসবে বলে সওজের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুসারে, এপ্রিল পর্যন্ত মূল সেতুর কাজ এগিয়েছে ৯৮ শতাংশ। নদীশাসনের কাজের অগ্রগতি ৯২ শতাংশ। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ। পদ্মা সেতুর (মূল সেতু) দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তের উড়ালপথ ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। এটি পদ্মা নদীর দুই পাড়কে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা দিয়ে সরাসরি যুক্ত করবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। সেতু চালুর আগে প্রকল্প প্রস্তাব আবার সংশোধন করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। তবে ব্যয় বাড়বে কি না এবং বাড়লে কত বাড়তে পারে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। পদ্মা সেতু দিয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াত সহজ হবে, সময়ও কমবে। চলাচল সহজ করার পাশাপাশি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে পদ্মা সেতু। সমীক্ষা অনুযায়ী, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।