খোলাবাজারে প্রতি মার্কিন ডলার এখন কেনাবেচা হচ্ছে ১২৫ থেকে ১২৭ টাকায়। ডলারের এই উচ্চমূল্য ও সংকটে অস্থিরতা ছড়িয়েছে অর্থনীতিতে। অসহায় হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। কবে নাগাদ ডলারের দাম স্থিতিশীল হবে সে কথা কেউ জানে না। এমন সংকট উত্তরণে বাজারে ডলার সরবরাহ বাড়াতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে চেষ্টা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন অংশীজনরা। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের চেষ্টা করতে হবে। রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বাড়াতে হবে। অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমাতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্পের বৈদেশিক সাহায্য সময়মতো যেন পাওয়া যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি এর চাহিদা কমাতে হবে। বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশন- এফবিসিসিআই সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম বলেন, ডলারের সংকটে দেশের ব্যবসায়ীরা এখন অসহায় হয়ে পড়েছেন। অনেক ব্যবসায়ী ঋণপত্র বা এলসি খুলতে গিয়ে বিপদে পড়ছেন। একেক ব্যাংক একেক দরে ডলার কেনাবেচা করছে। ফলে পণ্য আমদানি খরচ বাড়ছে। শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এই সংকট উত্তরণে ডলার সরবরাহ বাড়াতে হবে। প্রবাসীদের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলে বেশি ডলার পাঠাতে গিয়ে প্রবাসীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এই হয়রানি দূরীকরণে বিদেশে থাকা বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। বেসরকারি ব্যাংক এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেডা) নির্ধারিত ব্যাংকগুলোয় ডলার দর রয়েছে ১১১ টাকা। খোলা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১২৬ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১২৭ টাকায়। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহামারি করোনার পর অর্থনীতিতে ডলারের বাড়তি চাহিদা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ডলারের দর বাড়িয়ে দিয়েছে। গত কয়েক মাস ব্যাংক ও খোলা বাজারে ডলারের বিনিময় হারের মধ্যে ব্যবধান কম ছিল। ব্যাংকে ডলারের মজুদ কম, দাম নির্ধারণ ও বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক ও খোলা বাজারে দামের ব্যবধান আবারও বেড়েছে। জানা গেছে, বেশির ভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংক ভ্রমণকারীদের কাছে ডলার বিক্রি করছে না। ফলে ডলার কিনতে তারা খোলা বাজারে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। রাজধানীর মতিঝিলে বেশ কয়েকটি মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠান জানান, তারা ১২৬ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১২৭ টাকায় ডলার বিক্রি করছেন। মানি চেঞ্জারদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে- চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া ব্যক্তি বা ভ্রমণকারীরা ডলার কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। মানি চেঞ্জাররা বিদেশি মুদ্রার যে মূল্য তালিকা করেছেন সেখানে ডলার বিক্রির দাম ১১৩ টাকা ৩০ পয়সা ও কেনার দাম ১১১ টাকা ৮০ পয়সা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই হার খুব একটা মানা হয় না। ডলার সংকটের এ সময়ে দর নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বাফেদার মাধ্যমে দর ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে এবিবি ও বাফেদার নির্ধারিত দর রয়েছে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। আর বিক্রির দর নির্ধারিত আছে ১১১ টাকা। কিন্তু চাহিদা মেটাতে বেশ কয়েকটি ব্যাংক ১২২ থেকে ১২৪ টাকা দরে ডলার কিনছে বিদেশি একচেঞ্জ হাউসগুলোর কাছ থেকে। আর আমদানিতে ডলারের দাম নিচ্ছে ১২৫ টাকা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংক নির্ধারিত ডলারের দাম খোলা বাজারে বাড়তি চাহিদা তৈরিতে সহায়তা করেছে। তারা মনে করেন, খোলা বাজারে প্রবাসী বাংলাদেশিরা যখন ডলারপ্রতি ১২৭ টাকা পাবেন, তখন তারা ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো থেকে বিরত থাকবেন। ডলার আন্তর্জাতিক মুদ্রা যার গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বে সর্বোচ্চ। তাই সঙ্গত কারণেই ডলারের চাহিদা বরাবরই বেশী থাকে। করোনা পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধাবস্থা বিশ্বব্যাপী ডলারের বাজারকে অস্থির করে তুলেছে। এ অস্থিরতায় বাংলাদেশতো বটেই বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি অস্বাভাবিকভাবে এগুচ্ছে। এমনি অবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থা আরও বেশী অস্থির এবং অস্থিতিশীল। বাংলাদেশের ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স একটি বড় ভূমিকা পালন করে। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা কমে যাওয়ায় ডলারের বাজারে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আমরা মনে করি, চরম অবস্থা সৃষ্টির আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। ডলার পরিস্থিতি খারাপ করার পেছনে সিন্ডিকেটের ভূমিকার কথাও পত্রিকায় এসেছে। আমরা চাই যারা এ অপকর্মে জড়িত তাদের চিহ্নিত করা হোক। দোষীদের আইনের আওতায় এনে বিচারে মুখোমুখি করা হোক। সার্বিকভাবে ডলারের মত আন্তর্জাতিক মুদ্রাকে বাংকিং চ্যানেলে সহজলভ্য করার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। আমরা মনে করি দেশে আর্থিক খাতে এখন ডলার সমস্যা অনেক দিন ধরে ভোগাচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের কিছু পদক্ষেপ বিদেশ থেকে রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি করেছে। ডলার সংকট নিরসনে প্রয়োজনে আরও পদক্ষেপ নেওয়া হোক এটাই প্রত্যাশা।