সোহেল মাহমুদ ॥ গান সুর আর কথার ছন্দে সাপ খেলা দেখান খুলনার ৫ নম্বর ঘাটের সাপুড়ে সুজন। পেশায় সাপুড়ে হলেও মানুষের ভাগ্যগনণা ও চিকিৎসাও দিয়ে থাকেন তিনি। তার মূল পেশা সাপ ধরা এবং সাপের খেলা দেখানো। ছোট বেলায় কাজের সন্ধানে ঢাকায় গিয়ে সাভারের বেদে বহরে যোগ দেন, আর সেখান থেকেই রপ্ত করেন সাপ ধরা ও খেলা দেখানো। বাগেরহাটের চিতলমারীর বজলু খন্দকারের ছেলে মোঃ সুজন। বর্তমানে খুলনার ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের মন্দির রোডে ভাড়া বাসায় থাকেন। সংসারে এক ছেলে এবং স্ত্রী নিয়ে তার বসবাস। বড় দু’মেয়েরে বিয়ে দিয়েছেন। গত মার্চ থেকে করোনা ভাইরাসের কারনে সুজনের সাপের খেলা দেখানো বন্ধ হয়ে যায়। তবে তার সাপ ধরা বন্ধ হয়নি। সরকারি বিধি নিষেধ থাকলেও সম্প্রতী বাধ্য হয়ে আবার শুরু করেছেন খেলা দেখানো। তিনি বলেন, নিষেধ থাকলেও তিনি অল্প লোক নিয়ে খেলা দেখিয়ে আয় করতে বাধ্য হয়েছেন।
সুজন বলেন ২৫ বছর আগে তার সাপুড়ে জীবন শুরু। বলেন, আগে শহর গ্রাম সবখানেই সাপের দেখা মিলতো। সব সময় তিনি ব্যস্ত থাকতেন বিভিন্ন এলাকায় সাপ ধরতে, আয়ও ভালো ছিল। কিন্তু বর্তমানে দেশে সাপের উপদ্রব নেই বললেই চলে। তিনি জানান, মাঝে মধ্যে ডাক পাই। বর্তমানে যে কোন সাপ ধরতে গেলে তিনি কমপক্ষে হাজার টাকা নেন। এর পাশাপশি শহর ও গ্রামে সাপের খেলা ও ওষুধ বিক্রি করে দিনে গড়ে চার/পাঁচ’শ টাকা আয় হয়। সুজন জানান, দেশে সাপের তেমন দাম নেই। তারা যে সাপ ধরেন তা’ শুধু বেদেরাই সংগ্রহ করে খেলা দেখানোর জন্য।
খুলনার, ভৈরবের পাড়ে সুজনকে মাঝে মাঝে দেখা যায় সাপ খেলা দেখাতে। কিন্তু খেলা দেখে মানুষ আর টাকা দিতে চায় না। প্রতিবার প্রায় ১ ঘন্টা খেলা দেখিয়ে কখনো এক’শ আবার কখনো পাঁচ’শ টাকা পান সুজন। আবার কখনও কোন টাকাই পাননা। এভাইে চলে সুজনের জীবন। তবে হাল ছাড়েননি সুজন। সাপ খেলার পাশাপশি মানুষের ভাগ্যবলে দিয়ে মাঝে মাঝে তাক লাগিয়ে দেন খেলা দেখতে আসা দর্শকদের। এসময় অনেকেই তার কথায় মোহিত হয়ে কিনে নেন নানা ধরনের ভেষজ ওষুধ। সুজন বলেন, করোনার আগে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি অনুষ্ঠানে তার ডাক পড়তো সাপ খেলা দেখাতে। সাপের খেলা দেখিয়েছেন বিয়ে বাড়িতেও। প্রতিটি অনুষ্ঠানে তিনি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পেতেন। কখনও কখনও এর চেয়েও বেশী পেতেন। কিন্তু করোনার শুরু থেকে সব অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
সুজন জানান, সাপ পোষা অত্যান্ত বিপদজ্জনক ও ব্যায় বহুল। সাধারণত সাপেদের ব্যাঙ, কুচে ও মাছ খেতে দেওয়া হয়। তবে সপ্তায় অন্তত দু’দিন শিং মাছ না দিলে সাপের স্বাস্থ্য ঠিক থাকেনা, ঝিমিয়ে পড়ে। এছাড়া যে কোন সাপের বিষদাত ভেঙে দিলেও আবার দাত ওঠে এজন্য নিয়মিত পরীক্ষা করতে হয়। দাত উঠলে আবার সাবধানে সেটা ভেঙে দিতে হয়। তিনি বলেন, সাপে কাটা রোগির চিকিৎসায় তিনি কিছু ওষুধ ও গাছ ব্যবহার করেন। তিনি দাবি করেন, তার চিকিৎসায় সাপে কাটা রোগি সুস্থ হয়ে যায়। এছাড়া গত পঁচিশ বছরে তিনি যাদের চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করেছেন তারা অনেকেই দূরদূরান্ত থেকে তাকে রোগি পাঠান। আবার অনেক ভক্ত আসেন তার সাথে দেখা করে শ্রদ্ধা জানাতে।
নগরীর ওয়েস্ট মেকট রোডের বাসিন্দা মোঃ আজিবর গাজী বলেন, আগে সাপ খেলা দেখে লোকে যা দিত তাতে সুজনের সংসার চলতো কিন্তু বর্তমানে করোনার কারনে কেউ আর সাপ খেলা দেখে টাকা দিতে চায় না। এজন্য সুজনের আর্থিক অবস্থা এখন ভালোনা। ৫ নম্বর ঘাট জোড়া শিব মন্দির এলাকার বাসিন্দা মোঃ সবুর বলেন, সুজনের সাপ খেলা দেখতে আগে অনেক লোক আসতো এখন করোনা রোগের কারনে সাপ খেলা দেখতে মানুষ আর আসেনা। যে কারনে তার আয়ও হয় কম।
খুলনা জেলা কালচারাল অফিসার সুজিত কুমার সাহা বলেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় শিল্পকলার সঙ্গে যারা যুক্ত রয়েছে তাদের জন্য দুর্যোগকালীন সময়ে শিল্পকলা ভূমিকা রেখেছে। তিনি বলেন, যারা সাপ খেলা দেখায় তাদেরকে বেদে সম্প্রদায়ের ভ্রাম্যমান মানুষ হিসেবে ধরা হয় এজন্য এদের কে চিহ্নিত করা বেশ কঠিন। তিনি বলেন, সাপুড়ে সম্প্রদায়ও আমাদের সংস্কৃতির অংশ এদেরও তালিকাভূক্ত করা উচিত। তিনি বলেন, শুধু সাপুড়েনা যে বিষয়গুলি আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে আমরা দেখে আসছি যারা এই ধারাগুলোকে নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা যদি শিল্পকলার সাথে সরাসারি সম্পৃক্ত থাকেন তবে তাদেরকে আমরা তালিকাভূক্ত করতে পারবো। এবং তারা তখন সরকারি সব ধরনের সহযোগিতার আওতায় আসবে।
খুলনা বিভাগীয় বন্য প্রাণি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল বলেন, বেদে বা সাপুড়ে সম্প্রদায় আমাদের সংস্কৃতির একটা অংশ এরা যুগ যুগ ধরে রয়েছে। সাপ বা বানরের খেলা দেখিয়ে তারা রোজগার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এদের মধ্যে বন্য প্রাণি পাচার বা বানিজ্যিক কোন বিষয় জড়িত নেই।
খুলনা নগর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এর সভাপতি মোল্লা মারুফ রশিদ বলেন, খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন সংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে তারা দীর্ঘ এক যুগ ধরে কাজ করছেন। তিনি বলেন, খুলনা অঞ্চলে নৌকাবাইচ, সাপ খেলা, লাঠি খেলা, বানর নাচ, ঘুড়িওড়ানো, হাডুডু, গল্লাছুটসহ নানান ঐতিহ্যনিয়ে তারা দীর্ঘদিন নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পৃষ্টপোষকতা করে আসছেন। তিনি বলেন, সাপ খেলা খুলনা অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় ঐতিহ্য হলেও যথাযথ পৃষ্টপোষকতার কারনে হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সাপুড়ে শিল্পকে বাচিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্টপোষকতার পাশাপাশি যদি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সামনে স্প খেলা তুলে ধরা যায় তাহলে এ শিল্পটি নতুনভাবে এগিয়ে যাবে।
গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ হিসেবে একসময় গ্রামে গ্রামে ঘুরে সাপ ধরা ও সাপের খেলা বিনোদনের একটি মাধ্যম হলেও এখন সেই সাপ খেলা সচরাচর দেখা যায় না। সাপুড়েরা ওঝা নামেও পরিচিত। এরা সাপেকাটা রোগিদের চিকিৎসাও দিয়ে থাকে। প্রচলিত আছে ওঝারা সাপে-কাটা মরা মানুষকেও জীবিত করতে পারে।
বর্তমানে প্রকৃতি থেকে সাপের আবাসন কমার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে সাপ। যে কারনে সাপুড়ে সম্প্রদায়ও বাধ্য হচ্ছে পেশা পরিবর্তন করতে। দেশে এখনও দাঁড়াশ, চন্দ্রমুখী, শঙ্খিনী, রাসেল ভাইপার, কালনাগিনী, গোঁখরো, দুধমনি, লাউডগা, অজগর, পঙ্খীরাজসহ বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ সাপ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি প্রকৃতি বাচলে এর উপর নির্ভশীল প্রাণি যেমন বাচবে। তেমনি প্রকৃতির উপর নির্ভর করে যারা জীবিকা নির্বাহ করে তারাও টিকে থাকবে। এজন্য সাপুড়ে সম্প্রদায়কে বাচাতে সরকারি পৃষ্টপোষকতার পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানদেরও ভূমিকা রাখতে হবে।