প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঢাকা-ভাঙ্গা অংশে বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল শুরু হচ্ছে ১ নভেম্বর। শুরুর দিকে এ রুটে চলবে দুটি ট্রেন-সুন্দরবন ও বেনাপোল এক্সপ্রেস। ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা-যশোরের মধ্যে চলাচল করা এ ট্রেন দুটিকে বঙ্গবন্ধু সেতু রুট থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে পদ্মা সেতু রুটে। তবে এ পথে ভ্রমণ সময় কিছুটা কমলেও যাত্রী পরিবহন করে ট্রেন দুটির আয় বাড়বে না। ফলে বাংলাদেশ রেলওয়ের রাজস্ব আয় বাড়াতে আপাতত কোনো ভূমিকা রাখছে না এ রেলপথ। রেলের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং দৈনন্দিন ট্রেন পরিচালনায় ২০০৯ সালের পর থেকে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। বর্তমানে চলমান রয়েছে ২৫টি উন্নয়ন প্রকল্প, যেগুলোর সম্মিলিত ব্যয় প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। বাস্তবায়িত ও চলমান প্রকল্পগুলোর সিংহভাগ করা হচ্ছে উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণে। বিশাল বিনিয়োগের বিপরীতে গত ১৪ বছরে রেলের রাজস্ব বেড়েছে সামান্যই। যাত্রী ও মালপত্র পরিবহন করে ২০০৯-১০ অর্থবছর বাংলাদেশ রেলওয়ের আয় ছিল ৫৬৬ কোটি টাকা। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রেলের বার্ষিক আয় দাঁড়িয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকার মতো (২০২০-২১ অর্থবছরে আয় ১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা)। বাংলাদেশ রেলওয়ের সূত্র ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রক্ষেপণ বলছে, ২০২৭ সাল নাগাদ আয় বেড়ে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকায় (২৮৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার) উন্নীত হতে পারে। আয় বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রেলের পরিচালন ব্যয়ও বেড়েছে। ফলে আয় বাড়লেও লোকসান কমেনি, উল্টো বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা। পর্যায়ক্রমে দেশের গুরুত্বপূর্ণ রেলপথগুলোকে ডাবল লাইনে উন্নীত করা হচ্ছে। নতুন রেলপথ ও সেতু নির্মাণ, পুরনো রেলপথসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সংস্কার করা হচ্ছে। সিগন্যাল ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। চলমান কয়েকটি প্রকল্প শেষ হলেই অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করবে। এ সময়ে শুধু লোকসানই বাড়েনি, ট্রেনের সময়ানুবর্তিতা, নিরাপত্তা, যাত্রীসেবার মানসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোয়ও উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি হয়নি। এর বিপরীতে বিদ্যমান নেটওয়ার্কে থাকা একটি বড় অংশের রেলপথ ও সেতু সংস্কারের অভাবে রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা নেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে। রেলের অধিকাংশ ইঞ্জিন-কোচের আয়ুষ্কালও ফুরিয়ে গেছে। জনবলের অভাবে বন্ধ রয়েছে অনেক স্টেশন। অন্যদিকে চলমান বিনিয়োগের বেশির ভাগই হচ্ছে কয়েকটি বড় প্রকল্পে। এর মধ্যে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পেই খরচ হচ্ছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে হচ্ছে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণে খরচ হচ্ছে ১৭ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। এছাড়া খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। এসব বড় প্রকল্প রেলের আয় বাড়াতে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের উদাহরণ টেনে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের পাশাপাশি রেললাইন করা হলো সমান্তরালভাবে। দুটো প্রকল্পই বিদেশী ঋণের। এক্ষেত্রে আমি মনে করি, এ ধরনের প্রকল্প হাতে নেয়ার সময় আমাদের আরো বেশি সচেতন হওয়া দরকার ছিল। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে আমাদের একটি শক্তিশালী যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। এখন ওই পথকে আরো বাধাহীন করা দরকার ছিল ভাঙ্গা থেকে। কিন্তু এখন রেললাইন হওয়ার কারণে একটি আরেকটির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে। সেক্ষেত্রে এ প্রকল্পগুলো নেয়ার আগে সম্ভাবতা যাচাই আরো সঠিকভাবে করার দরকার ছিল। কারণ অর্থনৈতিক রিটার্নের একটা শঙ্কা কিন্তু এখন রয়ে গেছে। বর্তমানে যে নেটওয়ার্ক রয়েছে সেখানে তো রিটার্ন কম। লোকসানে রয়েছে। প্রতি বছর একটি বড় অংকের লোকসান থাকে। সড়ক ও রেলপথ সম্প্রসারণের মধ্যে পার্থক্য অনেক বেশি। কারণ রেলপথ শুধু অবকাঠামোনির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা নয়। এটাকে প্রতিনিয়ত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। এর জন্য আবার আলাদা বিনিয়োগও করতে হয়। পদ্মায় সড়কের পাশাপাশি রেললাইন বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হবে বলে আমি মনে করি না। বর্তমানে রেলের যে নেটওয়ার্ক রয়েছে, সেটাই লাভজনক নয়। ক্রমাগত লোকসান দিয়ে যাচ্ছে। তার মানে আগের বিনিয়োগগুলোর সুফল সেভাবে পাওয়া যায়নি। চলমান বড় প্রকল্পগুলোর অর্থনৈতিক রিটার্ন নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। বড় প্রকল্পগুলো নেয়ার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই আরো সঠিকভাবে করার দরকার ছিল। চলমান অন্য বড় প্রকল্পগুলো নিয়েও একই ধরনের শঙ্কার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিনিয়োগে ভুল পথ অনুসরণ করছে রেলওয়ে। আমরা মনে করি, দেশে কম খরচে আরামদায়ক যোগাযোগ পরিবহনে রেল শীর্ষে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পসহ রেলের নেটওয়ার্ক উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কাজ চলছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে রেলের নেটওয়ার্কিং সম্প্রসারণের পাশাপাশি নতুন কোচ ও ইঞ্জিন সংগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দেওয়া জরুরি। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।