সোহেল মাহমুদ ঃ সুন্দরবনের চিত্রা হরিণ পালন দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে খুলনায়। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার হরিণের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় চিত্রা হরিণ। যার মায়াবী দৃষ্টি যে কোন মানুষকে আকর্ষণ করে। লাজুক স্বভাবের চঞ্চল প্রকৃতির চিত্রা হরিণ দলবদ্ধভাবে থাকে। হরিণ বন্যপ্রাণী হলেও গৃহপালিত প্রাণির মতো পোষ মানে। তবে বেশি মানুষ দেখলে হরিণ ঘাবড়ে যায়। হরিণের তেমন কোনো রোগবালাই হয় না, তাই পালনটা সহজ।
প্রাণির প্রতি ভালোবাসা থেকে মোঃ ইমরান হোসেন সজিব গল্লামারি এলাকায় নিজ বাড়িতে দীর্ঘদিন পশু-পাখি পালন শুরু করলেও ২০১৮ সালের শেষ দিকে খুলনার লবণচরা এলাকায়া সাড়ে ৮ বিঘা জমির উপর সেড ও ঘেরা দিয়ে সজিব হ্যাচারী এন্ড মিনি পার্ক গড়ে তোলেন। প্রথমে কেশবপুরের একটি খামার থেকে চারটি হরিণ সংগ্রহ করে পালন শুরু করেন। বর্তমানে তার পার্কে রয়েছে ১১টি হরিণ। এর মধ্যে দুটি বাচ্চা সম্প্রতি জন্ম নিয়েছে এবং ৯টি হরিণের নিবন্ধন করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রথমে সৌখিন লাইসেন্স করলেও ১০টির বেশী হরিণ থাকলে খামারীর জন্য লাইসেন্স নেওয়ার সুযোগ থাকায় এবার তিনি খামারির লাইসেন্স করবেন। তিনি জানান, ইতিমধ্যেই খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হরিণ নেওয়ার জন্য প্রতিদিনই তার সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ করছেন। জানান, বর্তমানে প্রাপ্ত বয়স্ক এক একটি হরিণের দাম ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা রয়েছে। সজিব হ্যাচারী এন্ড মিনি পার্কে হরিণ ছাড়াও রয়েছে ইমু পাখি, উট পাখি, টার্কি, রিয়া, সিল্কি মুরগী এবং বিদেশি ছাগল। তবে পার্কটি এখনও নির্মাণাধীন থাকায় দর্শনার্থীদের জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত রয়েছে।
সজিব হ্যাচারী এন্ড মিনি পার্কের ব্যবস্থাপনায় থাকা মোহাম্মদ আসিফ শেখ বলেন, আমাদের পার্কের হরিণের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। হরিণ খুবই নিরীহ প্রাণি। এরা আমাদের সাথে বন্ধুর মতো হয়ে গেছে। হরিণ গমের ভূসি, ডালের ভূষি, গুঁড়া সয়াবিন, মালঞ্চ-কলমি পাতা, কেওড়া ফল, বাঁধাকপি প্রভৃতি খাবার খাবার খায়। হরিণের তেমন কোন রোগ হয়না, তারপরও আমরা নিয়মিত এদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করি। আসিফ বলেন, আমাদের পার্কে প্রতিদিনই অনেক মানুষ
হরিণ পালন সম্পর্কে বন ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বিভাগ খুলনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল বলেন, “বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ এর অধীনে হরিণ ও হাতি লালন পালন বিধিমালা ২০১৭ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর আওতায় ব্যক্তি পর্যায়ে সৌখিনভাবে এবং খামার পর্যায়ে লালন-পালন করার সুযোগ হয়েছে। তিনি বলেন, খুলনা বন ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বিভাগ এর আওতায় ৩৩টি হরিণ পালনের লাইসেন্স দেওয়া হয় এবং বিধি না মানার কারনে ৪টি লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।”
বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন সূত্রে জানা যায়, হরিণ পালন ও খামার করার আগে বন অধিদফতর থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। বন বিভাগের লিখিত অনুমতি ছাড়া কেউ হরিণ ক্রয়-বিক্রয় লালন-পালন করতে পারবেনা। এছাড়া হরিণ কেনার আগে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে উৎসাহীরা হরিণ পালনের জন্য বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কাছে আবেদন করবেন। অপরদিকে খামার করতে আবেদন করতে হবে বন সংরক্ষক বরাবর। আবেদন পাওয়ার পর বন কর্মকর্তারা হরিণের আবাস পরিদর্শন করবেন। তারপর আগ্রহীকে সার্টিফিকেট দেওয়া হবে।
হরিণ পালনের ক্ষেত্রে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী প্রতিটি হরিণের জন্য একশ বর্গফুটের সেড থাকতে হবে এবং পাঁচ’শ বর্গফুট ঘেরা বিচরণ ক্ষেত্র থাকতে হবে। পাশাপশি হরিণ থাকার উপযোগি পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পয়নিষ্কাশন সুবিধাসহ পরিচ্ছন্ন পরিবেশ থাকতে হবে। হরিণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্ত খামারি বা চিড়িয়াখানা থেকে বন বিভাগের অনুমনি নিয়ে হরিণ সংগ্রহ করা যাবে। এছাড়া প্রতিটি হরিণের জন্ম ও মৃত্যু সনদ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জনের কাছ থেকে সংগ্রহ করে বন বিভাগকে অবহিত করে নিবন্ধন নিতে হবে। প্রতিবছর হরিণের লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে এবং হরিণ প্রতি ১ হাজার টাকা সরকারি রাজস্ব ও ভ্যাট দিতে হবে।
খুলনা জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা এস এম আওয়াল হক বলেন, খুলনাতে ব্যক্তি পর্যায়ে বেশ কিছু হরিণ পালন হচ্ছে। এটি বন্য প্রাণি হলেও আমরা নিয়মিত হরিণের স্বাস্থ্যসেবা এবং জন্ম ও মৃত্যু সনদ দিয়ে থাকি। তিনি বলেন, সুন্দরবনের চিত্রা হরিণ একটি ঐতিহ্যবাহি প্রাণি, এটি বনের প্রাণি এটাকে বনেই মানায়। তিনি বলেন, হরিণ পালন করলে পোষ মানে এবং পোষা প্রাণির মতো আচরণ করে। আমাদের পরিবেশে হরিণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কম।
২০০৯ সালের চিত্রা হরিণ লালন-পালন সংক্রান্ত নীতিমালায় হরিণ পূর্ণ বয়স্ক হলে তার মাংস খাওয়ার অনুমতি থাকলেও ২০১৭ সালের নতুন বিধিমালায় তা বন্ধ করা হয়। এ ছাড়া যেসব বনে হরিণ পাওয়া যায় তার ৩০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে কোনো খামার না করার বিধান রাখা হয়। সুন্দবনের হরিণের প্রতি আগ্রহের কারণে শুধু প্রদর্শনের জন্য দেশ ও বিশে^ হরিণের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সরকারের নীতিমালা মেনে হরিণের প্রজনন বাড়ানো গেলে হরিণ রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব বলে মনে করেন এ শিল্পের সাথে জড়িতরা।