গণমাধ্যমকর্মীদের তীব্র প্রতিবাদ, পরিচালককে লিগ্যাল নোটিশ
স্টাফ রিপোর্টার: খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি এবং একই দিনে সেটি প্রত্যাহার এমন নাটকীয় ঘটনায় খুলনার সাংবাদিক সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। হাসপাতালের পরিচালক ডা. কাজী মো. আইনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত দু’টি পরস্পর বিরোধী অফিস আদেশে তৈরি হয়েছে জটিল পরিস্থিতি।
ঘটনাটি গত বৃহস্পতিবারের। ওই দিন পরিচালক প্রথমে এক অফিস আদেশে হাসপাতাল চত্বরে সাংবাদিকদের প্রবেশ, ছবি তোলা ও সংবাদ সংগ্রহে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, একই তারিখে দ্বিতীয় একটি চিঠিতে তিনি সেই আদেশ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। দুটি আদেশেই ভাষাগত অসঙ্গতি ও তারিখের মিল থাকায় প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রথম অফিস আদেশে পরিচালক উল্লেখ করেন,পরিচালকের অনুমতি ছাড়া কিছু মিডিয়াকর্মী হাসপাতালে রোগীদের ছবি তুলছেন, যা কাম্য নয়। এতে রোগী ও চিকিৎসক উভয়েই হয়রানির শিকার হচ্ছেন এবং সাংবাদিকদের আনাগোনায় স্বাভাবিক চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। সে অনুযায়ী, পরিচালকের লিখিত অনুমতি ছাড়া কোনো সাংবাদিক ইনডোর বা আউটডোরে ছবি তুলতে বা সাক্ষাৎকার নিতে পারবেন না বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে ডা. কাজী মো. আইনুল ইসলাম বলেন, ঢাকাসহ দেশের অনেক মেডিক্যালে এমন নিয়ম রয়েছে। সাংবাদিকদের অবাধ চলাফেরার কারণে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছিল, তাই চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তবে বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতেই খুলনার সাংবাদিক সমাজে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন একে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে নিন্দা জানায় এবং আদেশ প্রত্যাহারের দাবি তোলে।
প্রতিক্রিয়ার মুখে গতকাল রবিবার পরিচালক দ্বিতীয় এক চিঠিতে পূর্বের আদেশ প্রত্যাহারের কথা জানান। কিন্তু সেটিতেও তারিখ দেখানো হয়েছে ৯ অক্টোবর অর্থাৎ, নিষেধাজ্ঞা ও প্রত্যাহার দুটি আদেশই একই দিনের তারিখে ইস্যু করা হয়েছে, যা নিয়ে আরও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
নতুন চিঠিতে বলা হয় অফিস চলাকালীন সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক বা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে সাংবাদিকরা সাংবাদিকতার নীতিমালা মেনে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারবেন।
এই ঘটনায় খুলনা টিভি রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি আবু হেনা মোস্তফা জামাল পরিচালক ডা. কাজী মো. আইনুল ইসলামের বিরুদ্ধে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন। আইনজীবী বাবুল হাওলাদারের মাধ্যমে পাঠানো নোটিশে বলা হয় পরিচালকের এমন আদেশ বাংলাদেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনবিরোধী। এটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নাগরিকের বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী। নোটিশে আরও বলা হয় তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে সাংবাদিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ মধ্যযুগীয় মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদেশ প্রত্যাহার না করা হলে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় খুলনা প্রেসক্লাবে এক জরুরি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ক্লাবের আহবায়ক এনামুল হক, এবং সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক রফিউল ইসলাম টুটুল।
সভায় বক্তারা বলেন, এ ধরনের আদেশ গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং স্বাধীন, নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার প্রতি এক প্রকার হুমকি। তারা আরও বলেন, এই নির্দেশনা শুধু সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না, বরং জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের প্রবাহও ব্যাহত করবে যা একটি গণতান্ত্রিক সমাজে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
দ্বিতীয় আদেশে সাংবাদিকদের ইথিক্স মেনে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সাংবাদিকতা করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বক্তারা প্রশ্ন তোলেন একজন সরকারি হাসপাতালের একজন পরিচালক কীভাবে সাংবাদিকদের নীতিশাস্ত্র মেনে চলার নির্দেশ দিতে পারেন? তারা এ বিষয়টি প্রশাসনিকভাবে তদন্তেরও দাবি জানান।
বক্তারা আরও বলেন, এ ধরনের নির্দেশনা জনসম্পৃক্ত হাসপাতালের তথ্য সংগ্রহ, সাক্ষাৎকার ও অনুসন্ধানমূলক কার্যক্রমকে নিরুৎসাহিত করে, যা স্বাধীন মতপ্রকাশ ও তথ্য জানার সাংবিধানিক অধিকারকে ক্ষুন্ন করে। তারা আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতাল পরিচালককে ওই অফিস আদেশ প্রত্যাহার ও নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানান।
সভায় বক্তব্য রাখেন প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি এস এম হাবিব, নির্বাহী সদস্য ও দৈনিক খুলনাঞ্চল পত্রিকার সম্পাদক মোঃ মিজানুর রহমান মিলটন, নির্বাহী সদস্য আশরাফুল ইসলাম নূর, সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাসান আহমেদ মোল্লা, দৈনিক প্রবর্তন পত্রিকার সম্পাদক মো. মোস্তফা সরোয়ার, এবং সাংবাদিক রাশিদুল ইসলাম, আবুল হাসান হিমালয়, হেদায়েত হোসেন মোল্লা, আব্দুর রাজ্জাক রানা, অভিজিৎ পাল ও বেল্লাল হোসেন সজল প্রমুখ।
এসময় উপস্থিত ছিলেন ক্লাব সদস্য দেবব্রত রায়, কাজী শামিম আহমেদ, মো. হুমায়ুন কবীর, মো. আমিরুল ইসলাম, শেখ শামসুদ্দীন দোহা, কামরুল হোসেন মনি প্রমুখ। এছাড়াও সাংবাদিক রফিক আলী, মাশরুর মুর্শেদ, জি এম রাসেল, এস রুহুল আমিন ও ওবায়দুর রহমান পলাশ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞায় মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠন তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।
এমইউজে ও বিএফইউজে: খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন, খুলনা এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) নেতৃবৃন্দ। এক যৌথ বিবৃতিতে তারা অবিলম্বে এ আদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানান।
বিবৃতিদাতারা হলেন মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন খুলনার সভাপতি মো. আনিসুজ্জামান, সহ-সভাপতি ও বিএফইউজের সহকারী মহাসচিব এহতেশামুল হক শাওন, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসান হিমালয়, কোষাধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাক রানা, নির্বাহী সদস্য মুহাম্মদ নূরুজ্জামান ও সোহরাব হোসেন। অনুরূপ বিবৃতি দিয়েছেন বিএফইউজের সাবেক সহ-সভাপতি ড. মো. জাকির হোসেন, আবু তৈয়ব, মো. রাশিদুল ইসলাম, সাবেক নির্বাহী সদস্য শেখ দিদারুল আলম ও এইচ. এম. আলাউদ্দিন।
বিবৃতিতে সাংবাদিক নেতারা বলেন, হাসপাতালের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার কথা বলে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী। সাংবাদিকরা সর্বদা পেশাগত নীতিমালা ও মানবিক মর্যাদা বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। হাসপাতালের কার্যক্রম স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রাখতেই গণমাধ্যমের উপস্থিতি অপরিহার্য। তারা আরও বলেন, দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সাংবাদিকরা জনস্বার্থে তথ্য সংগ্রহ, ভিডিও ধারণ ও প্রকাশের অধিকার ভোগ করেন। কেউ যদি সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘন করেন, তবে নির্দিষ্টভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু পুরো সাংবাদিক সম্প্রদায়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার শামিল।
আমরা খুলনাবাসী: একই ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন নাগরিক সংগঠন বৃহত্তর আমরা খুলনাবাসী এর নেতৃবৃন্দ। তারা গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ সমাজ ব্যবস্থার পরিপন্থী। তারা অবিলম্বে আদেশ প্রত্যাহার ও সাংবাদিকদের অবাধ প্রবেশাধিকার পুনঃস্থাপনের দাবি জানান।
বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন বৃহত্তর আমরা খুলনাবাসীর সভাপতি ডাঃ মোঃ নাসির উদ্দিন, ডাঃ সৈয়দ মোসাদ্দেক হোসেন বাবলু, ডাঃ আঃ সালাম, মোঃ জামাল মোড়ল,মোঃ সিরাজ উদ্দিন সেন্টু,এডঃ কাজি আমিনুল ইসলাম মিঠু, মোঃ কামরুল ইসলাম কামু, জি এম মহিউদ্দিন, নিয়াজ আহমেদ তুহিন, সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান খোকন,শেখ মোহাম্মদ আলী,এম এ জলিল, মোঃ কামরুল ইসলাম ভুট্রো,কাওসারী জাহান মন্জু, সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ শাকিল আহমেদ রাজা,আঃ রাজ্জাক,মোঃ জাহাঙ্গীর চৌধুরী টিপু, খন্দকার তৈয়েবুল ইসলাম টিম,তালুকদার মোঃ হেলালুজ্জামান,মোঃ সবুজুল ইসলাম,মোঃ খায়রুল আলম,ডাঃ মাহ্ফিজুর রহমান বাচ্চু, লিটন মিত্র,মোঃ মামুন অর রশিদ,মোঃ খায়রুজ্জামান শিপন,মোঃ রেজওয়ান হোসেন, মোঃ মেজবাহ উদ্দিন পাপ্পু, মোঃ আবু বক্কার, মোঃ আজমল হোসেন সহ প্রমুখ। তারা ঘোষণা দেন, আজ সোমবার দুপুর ১২টায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, দুর্নীতি, অনিয়ম ও এক রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় অবস্থান কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে। এই কর্মসূচি সফল করতে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।