মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগর থেকে ফিরলো খালি হাতে
জুনের ১২ তারিখ। সরকার ঘোষিত ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ। মনে আশা, চোখে স্বপ্ন, বুকভরা সাহস নিয়ে সাগরে পাড়ি জমিয়েছিলেন দক্ষিণের হাজারো জেলে। কিন্তু সাগর যেন ভিন্ন এক গল্প বলছে, ঝড়ো হাওয়া, উঁচু ঢেউ, মাছের অনুপস্থিতি। নিষেধাজ্ঞা শেষ হলেও উপক‚লের জেলেপাড়ায় এখন উৎসবের চেহারা নেই, নেই রসদের ব্যাগে চাল-ডাল। আছে শুধু উৎকণ্ঠা, জীবন চলবে কীভাবে?
বাগেরহাটের মোংলা ফিসারিজ ঘাটের জেলে হারুন মাঝির কণ্ঠ কেঁপে ওঠে ৫৮ দিন বসে আছিলাম, তহন কইছি, আর কয়দিন পরে গিয়া মাছ ধরব। বাজার করছিলাম ধার কইরা। এইবার সাগরে গিয়াও লাভ হয় নাই। ঢেউয়ের মধ্যে মাছও নাই। এখন আবার কার কাছে যাব? মহাজনও কয়, আমারেও লোকসান হইছে।
জীবনের এই লড়াই হারুনের একার নয়। খুলনার নলিয়ান, হরিঢালী, চালনা, চরখালী, বাগেরহাটের মোংলা ফিসারিজ ঘাট, রায়েন্দা, বগী, দিগরাজ সাতক্ষীরার গাবুরা, মুন্সিগঞ্জ, ছয়হালি, কাঠালিয়াসহ উপকুলীয় জেলার হাজারো জেলে পরিবার এখন একই কষ্টের সাগরে ডুবে আছে।
খুলনার হরিঢালী গ্রামের জেলে আকরাম মাঝি বললেন, বাচ্চা লইয়া ভাবি কি করবো। স্কুলে ফিস দিতে পারি নাই। ছেলেটারে কয়বার পাঠাইছি আবার আনছি। লজ্জা লাগে। মাছ ধরা ছাড়া তো আর কিছু পারি না। কাজের মানুষও কেউ চায় না।
এই গল্প শুধুই অভাবের নয় মানুষ হবার লড়াইয়ের।এই পরিবারগুলো দিন এনে দিন খায় ,দিন না এনে বাঁচে কি করে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী মিডিয়াতে দেয়া এক বক্তব্যে বলেন, নিষেধাজ্ঞা, মাছের প্রজনন, সংরক্ষণ সবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেটার সুফল যদি ভোক্তা ভোগ করে, উৎপাদক জেলে না পায়, তাহলে রাষ্ট্রীয় নীতিতে ফাঁক থেকেই যায়।
তিনি জোর দিয়ে বলেন,আমাদের দরকার একটি দীর্ঘমেয়াদি লাইভলিহুড সিকিউরিটি প্যাকেজ। শুধু চাল-ডাল নয়, দরকার সহজ শর্তে ঋণ, স্বাস্থ্যসেবা, বিকল্প পেশায় প্রশিক্ষণ, শিশুদের পড়াশোনার নিশ্চয়তা।
সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জের জেলে রফিক মিয়া ১৫ দিনের জন্য সমুদ্রে গিয়েছিলেন। পাঁচ লাখ টাকার জিনিসপত্র কিনে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এখন বলছেন একবারই ভাবতেছি, কিছু না পাইলে ফিরে আইসা কি করব ? সাগরে মরলে কমপক্ষে শান্তি মিলবো… ঘরে তো না খাইয়া মরতে হয়।
খুলনা বিভাগে প্রায় ৪৩ হাজার লোক জেলে হিসেবে পরিচিত এর মধ্যে ৩১,৫০০ জন নিয়মিত সমুদ্রজেলে কাজ করেন। বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় মূলত মৌসুম ভিত্তিতে হাজার-খানেকেরও বেশি জেলে সক্রিয় থাকেন, যা সমুদ্র-ইলিশজালে নিয়োজিত।আঞ্চলিক হিসেব নেই স্পষ্ট, তবে তারা স্থানীয় সামুদ্রিক ইলিশ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সরকারি হিসাবেই বছরে অন্তত ২৫০ থেকে ২৭০ দিন কোনো না কোনোভাবে মাছ ধরা বন্ধ থাকে। সাগরে মা ইলিশ রক্ষায় ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা, ও অভয়াশ্রমে মার্চ-এপ্রিলে মাছ ধরা বন্ধ ২২ দিন ও জাটকা সংরক্ষণে ৮ মাস নিষেধাজ্ঞা থাকে ।
উপরের সব নিষেধাজ্ঞা অঞ্চলভেদে কার্যকর হলেও বাস্তবে উপক‚লীয় জেলেরা প্রায় পুরো বছরই অসহায়। জেলেদের হিসেবে তারা বছরে আয় করতে পারেন বড়জোর ৩-৪ মাস। আর বাকি সময়টা চলে ধারদেনা আর মহাজনের কাছে ধর্ণা দিয়ে।