ওবায়দুল কবির সম্রাট,কয়রা (খুলনা): দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জনপদ খুলনার কয়রা উপজেলা। উপজেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ২৪.১৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বঙ্গপোসাগরের তীরবর্তী সুন্দরবন ঘেষা সর্ব শেষ জনপদ উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি। ইউনিয়নটি ৩ পাশে নদী দ্বারা বেষ্টিত। দক্ষিণ ও পূর্বে সুন্দরবন এবং শাকবাড়িয়া নদী ,পশ্চিমে কপোতাক্ষ নদী ও উত্তরে কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়ন। ইউনিয়নটির ১২ টি গ্রামের যাতায়াতের প্রায় সব রাস্তা কাঁচা এবং ইট বিছানো। যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। বৃষ্টি হলে চলেনা কোন যানবাহন। পায়ে হেঁটে যেতে হয় গন্তব্যে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,এলাকাটি উপজেলার একটি প্রাচীন ইউনিয়ন হলেও কোথাও নেই পাকা ( পিচ ঢালাই) সড়ক। দু’একটি ইটের সড়ক থাকলেও সেগুলোর ইট উঠে খাঁনা খন্দে পরিণত হয়েছে । ইউনিয়নের গ্রাম গুলোর অধিকাংশ বাড়ি ঘর এখোনো কাঁচা(মাটির ঘর)। পয় নিষ্কাশন ব্যবস্থা এখানো অত্যন্ত নাজুক । এখানকার মানুষের একমাত্র জীবিকা সুন্দরবনে মাছ ও কাঁকড়া আহরণ ।কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে জেলেরা তাদের মাছ ও কাঁকড়ার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের আহরণ করা মাছ কাঁকড়া উপজেলা সদর থেকে ট্রাকযোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যয়বৃদ্ধির কারণে জেলেরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়,দুর্গম জনপদ দক্ষিণ বেদকাশিতে ২৮ হাজার ৭ শত মানুষের বসবাস। প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ ইউনিয়ন এটি। বঙ্গোপসাগর থেকে সৃষ্ট যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রথমে আঘাত হানে ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। ২০০৯ সালে আইলা থেকে শুরু করে সবশেষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ রিমেলও এখানে আঘাত হানে ,বেঁড়িবাধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয়। এখানকার বাসিন্দাদের দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই। নেই জীবনমানে উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া। সারা বছরই দুর্যোগ আর বৃষ্টিতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় এই দুর্গম ইউনিয়নটির বাসিন্দাদের।
ঘড়িলাল গ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ী আব্দুর রব মিঠু বলেন, বেড়িবাঁধের ওপর মাটির রাস্তা। এই রাস্তাই এই ইউনিয়নের প্রধান সড়ক। কোথাও ইটের সোলিং আছে, কোথাও নেই। ইউনিয়নের ১২ গ্রামে যাতায়াতের প্রধান যান ভ্যানগাড়ি আর মোটরসাইকেল। তবে ভ্যানগাড়ি সবখানে চলে না। মোটরসাইকেল ছোট রাস্তা দিয়ে চলাচল করে। মৎস্য খামারের জন্য কোন খাদ্য ও অন্যান্য মালামাল আনতে হলে বেশি খরচ দিয়ে নদী পথে আনতে হয়। কষ্টের সঙ্গেই বসবাস আমাদের।
ছোট আংটিহারা গ্রামের বাসিন্দা ৭০ বছরের বৃদ্ধ কামরুল ইসলাম বলেন, আমাদের মতো অবহেলিত ইউনিয়ন দেশের কোথাও নেই। রাস্তাঘাট নেই, বাঁধের ওপর দিয়ে চলতে হয়। বৃষ্টি হলে চলাচলের উপায় থাকে না। দুঃখের শেষ নেই।
দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন , চরমভাবে অবহেলিত দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়ন। ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের রাস্তাঘাটগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। প্রতিনিয়ত দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এখানকার মানুষের বেঁচে থাকাটা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাতায়াতের জন্য ভালো রাস্তা না থাকায় এমপি ও সরকারি কর্মকর্তারা এখানে আসেন না বললেই চলে। এক কথায় এখানে কোনো উন্নয়ন নেই। জীবনমান উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপও নেই কারও।
দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের বাসিন্দারা বলেন, দুর্ভোগের কোনো অন্ত নেই ইউনিয়ন বাসির । কোনটা রেখে কোনটা বলবো। প্রধান দুর্ভোগ এলাকায় চলাচল উপযোগী কোনো রাস্তা নেই।বর্ষা মৌসুমে রাস্তা দিয়ে চলাফেরার কোনো উপায় থাকে না। কাদামাটি দিয়ে চলাচল করতে হয়। জুতা পরে রাস্তায় চলা যায় না। চলে না কোনো যানবাহন। উন্নয়নের কথা শুনলেও চোখে দেখি না। আমাদের রাস্তাঘাটের কোনো উন্নয়ন হয়নি। তখন নদী পথই একমাত্র ভরসা । কেউ অসুস্থ হলেও উপজেলা সদর ও জেলা সদরে নেওয়ার সড়ক পথে কোন ব্যবস্থা নেই নদীতে পথে নৌকায় বা বোর্টে অনেক সময়ের ব্যাপার এর ভিতর রোগী আরও অসুস্থ হয়ে যায়।
ঘড়িলাল বাজারের ব্যবসায়ী মতিউর রহমান বলেন, নদীপথে উপজেলা ও জেলা শহর থেকে মালামাল এনে বিক্রি করতে হয়। সময় লাগে বেশি। টাকাও বেশি লাগে । বিকল্প পথ নেই। তবে জনপদের ভেতরে অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো যদি ভালো হতো; মানুষের দুঃখ-কষ্ট কমে যেত।
আংটিহারা গ্রামের আবুল গাজি, জব্বার মোড়ল,খায়রুল আলম,মোস্তফাসহ একাধিক জেলে আক্ষেপ করে বলেন, যখনই নির্বাচন আসে তখনই নেতাদের আনাগোনা বেড়ে যায়। রাস্তাঘাটসহ এলাকায় উন্নয়ন করবে- নির্বাচনের পর সব ভুলে যায়। এভাবেই কয়েক যুগ ধরে প্রতিশ্রæতি দিয়ে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। আর কত বছর গেলে আমরা এ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাবো।
দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান কবি শামছুর রহমান বলেন, কিন্তু যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় এখন ইউনিয়নটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হতে চলেছে।
এলাকার উন্নয়নের জন্য আগে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। সেটি আমাদের নেই। বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের যোগাযোগ ব্যবস্থার আওতায় আনার দাবি জানাই।তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আধুনিক এই যুগেও তার ইউনিয়নে কোনো পিচের (পাকা) রাস্তা নেই। ইউনিয়নের ২৭ কিলোমিটার সড়কের ১৫ কিলোমিটার একেবারেই চলাচলের অনুপযোগী। সম্প্রতি স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলমান আছে বাঁধগুলোতে মাটির কাজ করাই বৃষ্টি হলে চলাচল উপযোগী থাকে না ।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুলী বিশ্বাস বলেন ,উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি আসলেই দুর্গম ।আমরা সরকারি ভাবে চেষ্টা সব বাসিন্দাদের সকল প্রকার নাগরিক সুবিধা প্রদানের চেষ্টা করছি।