/ সংকটের প্রথম সারিতে খুলনার উপকূলীয় অঞ্চল

সংকটের প্রথম সারিতে খুলনার উপকূলীয় অঞ্চল

সুন্দরবন বনভূমি সংকোচনে জীববৈচিত্র্য হুমকিতে

#উপকূল থেকে ছড়িয়ে পড়ছে সংকট

মাশরুর মুর্শেদ : যদি এখনই সতর্ক না হই, আগামী প্রজন্ম আমাদের ভুলের দায় বইবে।এভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেন খুলনার এক প্রবীণ পরিবেশকর্মী। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা খুলনা বনভূমি সংকটের ফ্রন্টলাইনে অবস্থান করছে। প্রাণবৈচিত্র্য, আবহাওয়ার ভারসাম্য এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে যে ম্যানগ্রোভ বনভূমি সবচেয়ে কার্যকর, সেই সুন্দরবন ও তার আশপাশের অঞ্চলেই আজ সবচেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০০১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র খুলনা জেলায় ৪৩ হাজার ৬শত ৮৯ একর বনভূমি হারিয়েছে, যা ছিল দেশের সর্বোচ্চ। এরমধ্যে দাকোপ, কয়রা ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় বনভূমি হ্রাস সবচেয়ে বেশি।
খুলনা বিভাগীয় বন কার্যালয়ের ২০২৩ এর তথ্যানুযায়ী দাকোপে ১৬ হাজার ৫০০ একর বনভূমি চিংড়িঘের ও বসতির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। কয়রায় সুন্দরবনের সীমান্তঘেঁষা এলাকায় প্রায় ৮হাজার২০০ একর বনভূমি দখল হয়ে গেছে। এছাড়া বটিয়াঘাটায় অবৈধ বাগান, মধু আহরণ ও কাঠ কাটা মিলিয়ে অন্তত ৫ হাজার একর বনভূমি হুমকিতে।
ঋঅঙ এর ২০২০ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশে বন উজাড়ের বার্ষিক হার ২.৬%, যা বৈশ্বিক গড়ের দ্বিগুণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (ইইঝ) ২০২১ এর পরিসংখ্যান বলছে দেশের মোট ভূমির মাত্র ১৪.১% বনভূমি। পরিবেশগত ভারসাম্যের জন্য প্রয়োজন ২৫%। ২০২৩ সালের বন অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন বলা হয়েছে সারাদেশে ২০০১-২০২৩ সময়ে ২লাখ ৮৭হাজার ৪শত ৫৩ একর বনভূমি হারিয়েছে। খুলনা অঞ্চলেই ১৫% এর বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের উত্তর ও পশ্চিম সীমান্তে মানববসতি, মাছের ঘের, কলকারখানা ও বিদ্যুৎ প্রকল্পের স¤প্রসারণে বনপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. ফারহানা ইয়াসমিন মিডিয়াতে দেয়া এক বক্তব্যে বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষের বসতির চাপে সুন্দরবনের বাফার জোনগুলো মারাত্মক হুমকির মুখে। এর প্রভাব পড়ছে কাঁকড়া, কচ্ছপ, জল পাখিসহ বহু প্রজাতির ওপর।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়াও খুলনার বনভূমির জন্য হুমকি। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের (ইঈঈঞ) ২০২২ সালের গবেষণা বলছে, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে ২০৩০ সালের মধ্যে লবণাক্ততা দ্বিগুণ হতে পারে। বর্তমানে খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার শিবসা নদীতে সর্বোচ্চ লবণাক্ততা ১৪,৫০০ μঝ/পস রেকর্ড করা হয়েছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায় পানির লবণাক্ততা ১,৪২৭ থেকে ২,৪০৬ সম/খ পর্যন্ত পাওয়া গেছে, যা পানীয় জলের জন্য নিরাপদ সীমা (১,০০০ সম/খ) অতিক্রম করেছে। এছাড়া বাগেরহাটে লবণাক্ততা মাঝারি থেকে উচ্চ মাত্রায় (৫,০০১-১০,০০০ μঝ/পস) রেকর্ড করা হয়েছে, যা কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে ম্যানগ্রোভ ও কৃষিনির্ভর বনভূমি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
খুলনা বন সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসি এফ) শাহীনুর রহমান বলেন, বন অধিদপ্তর নিয়মিত অভিযান চালালেও প্রভাবশালী চিংড়িঘের মালিক ও স্থানীয় দখলদারদের বাধার মুখে টেকসই সাফল্য আসে না। আইনি সহায়তা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব প্রকট।
পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. মিজানুর রহমান জানান, আমরা পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়া কোনো প্রকল্প অনুমোদন দিই না। তবুও মাঠ পর্যায়ে দুর্বল মনিটরিংয়ের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই সুন্দরবনের ১০ কিমির মধ্যে গড়ে ওঠে অবৈধ স্থাপনা। স¤প্রতি আমরা খুলনায় ১১টি অবৈধ কারখানা বন্ধ করেছি।
অন্যদিকে, মৌচাষ, বনজ উদ্ভিদ, মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র, হস্তশিল্প, কাঠ ও গাছ-নির্ভর শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হাজারো পরিবার আয়হীন হয়ে পড়ছে বনহানির কারণে।
পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. নাহিদা সুলতানা বলেন, এখনই স্থানীয় সরকার, বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটির অংশগ্রহণে কমিউনিটি ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট গড়ে তুলতে হবে। একমাত্র তখনই প্রাকৃতিক বন তার গঠনগত কাঠামো ও জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনতে পারবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)ও বাপা খুলনা শাখার সমন্বয়কারী এড. বাবুল হাওলাদার বলেন,সুন্দরবন কেবল একটি বন নয়, এটি উপকূলবাসীর টিকে থাকার সুরক্ষা বেষ্টনী। বন না থাকলে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি ও সম্পদহানির ঝুঁকি বহুগুণ বাড়বে। তিনি বলেন,সুন্দরবন হারালে শুধু গাছ নয়, হারিয়ে যাবে জলবায়ু প্রশমনের প্রাকৃতিক ঢাল। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের গতি কমানোর অন্যতম অবলম্বন এই বন। খুলনার উপকূল এখনই সুরক্ষা না পেলে তা ছড়িয়ে পড়বে সারাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্য নিরাপত্তা, জীবিকায় হুমকি এবং জলবায়ু বিপর্যয়ের রূপে।